বুধবার, ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
কাকে নীরব করতে চাইছে ওয়াশিংটন?

আমেরিকার ভিসা-নীতির নতুন বার্তা

জীবন সালেহিন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২, ২০২৫, ১০:২৪ পিএম

আমেরিকার ভিসা-নীতির নতুন বার্তা

ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (UNGA) ৮০তম অধিবেশন সামনে। এই বৈশ্বিক মঞ্চে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কণ্ঠ যেন শোনা না যায়—এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যখন ওয়াশিংটন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ প্রায় ৮০ জন কর্মকর্তার ভিসা বাতিল/নামঞ্জুরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্টবনাম ভিসা রাজনীতি

১৯৪৭ সালেরUS–UN হেডকোয়ার্টার্স অ্যাগ্রিমেন্টের চেতনা হলো: জাতিসংঘে আমন্ত্রিত প্রতিনিধিদের প্রবেশের সুযোগ নিশ্চিত করা। অনেক সময় নিরাপত্তা-অজুহাতে ব্যতিক্রম হয়েছে—কিন্তু গোটা এক পক্ষকে কার্যত মঞ্চের বাইরে রেখে দেওয়া এ চুক্তির মূল উদ্দেশ্যেরই বিপরীত। এ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের দপ্তর থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তির বাধ্যবাধকতা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর এসেছে।

সময়টা কেন গুরুত্বপূর্ণ

এই সেপ্টেম্বরেই বহু পশ্চিমা দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে অগ্রসর হতে পারে—এমন জোরাল আভাস আছে। ঠিক এমন সময়েই ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠরোধের পদক্ষেপও দেখা গেল। কূটনীতিতে বার্তার সময়-নির্বাচন নিজেই এক বার্তা।

জাতীয় নিরাপত্তা’—নাকি কূটনৈতিক নীরবতা?

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বক্তব্য—ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব ‘প্রতিশ্রুতি মানছে না’, ‘সহিংসতা নিন্দায় ব্যর্থ’ ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে PA নেতৃত্ব সন্ত্রাসবাদ নিন্দা করেছে—এ যুক্তি প্রশ্নবিদ্ধ করে অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তিতেও দেখা যায়, সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক সংকেতের অংশ—রুবিও নেতৃত্বাধীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্পষ্ট জানায় যে তারা ভিসা ‘ডিনাই ও রিভোক’ করবে।

দ্বৈত মানদণ্ডের ছায়া

একদিকে ফিলিস্তিনিদের ভিসা অবরুদ্ধ; অন্যদিকে আইসিসি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে বৈঠক করছেন—এ দৃশ্য বিশ্বজুড়ে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’-এর ইঙ্গিত হিসেবে পড়া সহজ। আইসিসি-র প্রি-ট্রায়াল চেম্বার নিতান্তই আনুষ্ঠানিক কাগজ নয়, আদালতের বৈধ নির্দেশ।

সাংবাদিকতার উপর বাড়তি চাপ

গাজায় সাংবাদিক হত্যার ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক নিন্দা সত্ত্বেও কার্যকর জবাবদিহি নেই—এমন প্রেক্ষাপটে ভিসা-নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনি বয়ানের পথ আরও সঙ্কুচিত করে। এর মানে, কেবল কূটনীতির নয়, তথ্যপ্রবাহেরও এক ধরনের অবরোধ—যা গণতান্ত্রিক সমাজের প্রাণশক্তির বিরুদ্ধে যায়। (এ ইস্যুতে আল জাজিরাসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার ধারাবাহিক রিপোর্ট রয়েছে।)

তুর্কি ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াএকটি নতুন অক্ষের ইঙ্গিত

তুরস্কসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলো প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছে—এটা কেবল নীতিগত নিন্দা নয়; পশ্চিমা মৈত্রীজোটের ভেতরেই ফাটলের চিহ্ন। জাতিসংঘের মঞ্চে ফিলিস্তিনের কণ্ঠ বন্ধ হলে এর প্রতিক্রিয়া রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্য, সামরিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক কূটনীতিতেও পড়তে পারে।

বাংলাদেশের ও গ্লোবাল সাউথের শেখার জায়গা

১) মঞ্চ বাঁচান: বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পক্ষ-বিপক্ষের দোলাচলে আটকে না রেখে কথোপকথনের মঞ্চ হিসেবে রক্ষা করা জরুরি।
২) নীতিগত সামঞ্জস্য: মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে অবস্থান—বন্ধু/প্রতিপক্ষ নির্বিশেষে—বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
৩) তথ্যস্বচ্ছতা: গুজব-রাজনীতির যুগে দ্রুত, নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রবাহই আস্থার ভিত্তি।

আপনি যখন একটি জনগোষ্ঠীর কণ্ঠকে বৈশ্বিক মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেন, ইতিহাস তখনই সেই নীরবতাকে উচ্চারিত করে। কূটনীতির ভাষা শক্তির নয়, শুনবার। তাই প্রশ্নটা সোজা: ফিলিস্তিনিরা কথা বলবে নাএ সিদ্ধান্ত কে নেবে? আর কে শোনার সাহস দেখাবে?

মঞ্চ বন্ধ করলে যুদ্ধ থামে না, কেবল সত্য দেরিতে পৌঁছায়।

সূত্র: মার্কিন ভিসা-নিষেধাজ্ঞা ও UNGA-সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন/প্রতিক্রিয়া (Reuters, Axios, The Guardian, U.S. State Department, Al Jazeera, Democracy Now!, ICC) ।

লেখক: গবেষক ও সামাজিক চিন্তক

 

 

মাতৃভূমির খবর

Link copied!