শুক্রবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৫

ভূরাজনীতির ঝড় থেকে রক্ষায় প্রয়োজন জাতীয় প্রজ্ঞা

জীবন সালেহিন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ১১:৫৩ এএম

ভূরাজনীতির ঝড় থেকে রক্ষায় প্রয়োজন জাতীয় প্রজ্ঞা

ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল

CT Insider–এর সাম্প্রতিক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত কোনো সমাপ্তি নেই। সম্পাদকীয়টি ১৯৩৮ সালের মিউনিখ সম্মেলনের ঐতিহাসিক ব্যর্থতার সঙ্গে তুলনা করেছে। হিটলারকে তুষ্ট করার মাধ্যমে শান্তি আনার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু সেই আপস আরও বড় যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল। একইভাবে আজ যদি ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে আপসকেই সমাধান মনে করা হয়, তাহলে এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে। পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক করে সম্পাদকীয় বলছে—এই যুদ্ধ কেবল তখনই থামবে, যখন পুতিন মারা যাবেন বা ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করবে।

এখানেই বাংলাদেশের জন্য বড় শিক্ষা রয়েছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, অন্যায়ের সঙ্গে আপস দীর্ঘমেয়াদে কোনো সুফল আনে না। পাকিস্তান ১৯৭১ সালে সংলাপ, প্রস্তাব আর প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে তারা কখনো ছাড় দেয়নি। এর পরিণতিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের জন্মই প্রমাণ করে, প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সমাধান ছাড়া স্থায়ী শান্তি আসে না।

এ শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ভারত ও চীনের মাঝখানে, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেশটি সবসময় আন্তর্জাতিক মহাশক্তির নজরে থাকে। ইউক্রেনের মতো আমরাও মহাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় সহজেই চাপের মুখে পড়তে পারি। তাই পররাষ্ট্রনীতিতে অতি নির্ভরশীলতা বা একপাক্ষিক অবস্থান বিপজ্জনক হতে পারে। প্রয়োজন সবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা, কিন্তু জাতীয় স্বার্থকে সর্বাগ্রে রাখা।

ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই গম ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, সার ও জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে। ডলার সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এর থেকে শিক্ষা হলো, আমাদের কৃষি ও জ্বালানি নিরাপত্তা কেবল আমদানির ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে, বিকল্প জ্বালানি উৎস গড়ে তুলতে হবে, বাজার বৈচিত্র্য করতে হবে। নইলে যে কোনো বৈশ্বিক সংকট আমাদের অর্থনীতিকে কাবু করে দেবে।

রাজনৈতিক ঐক্যের দিক থেকেও ইউক্রেন যুদ্ধ শিক্ষণীয়। যুদ্ধ দীর্ঘ হওয়ার অন্যতম কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ বিভাজন, যা বাইরের শক্তিকে প্রভাব খাটানোর সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভক্তি যত বাড়বে, আন্তর্জাতিক শক্তি ততই এর সুযোগ নেবে। তাই দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে কমপক্ষে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। বিভক্তি কেবল বাইরের চাপকেই সহজ করে তোলে।

তরুণ প্রজন্মের জন্যও এখানে শিক্ষা রয়েছে। ইউক্রেনের তরুণেরা যুদ্ধক্ষেত্রে সাহস দেখাচ্ছে, বাংলাদেশি তরুণদের যুদ্ধক্ষেত্র শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে। একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতা হবে জ্ঞান ও দক্ষতার। তাই আমাদের তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে উন্নত শিক্ষা, প্রযুক্তি ও গবেষণায়। এটাই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার মূল শক্তি।

সবশেষে বলতে হয়, ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্লেষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভুল আপস বড় সংকট তৈরি করে। বাংলাদেশের জন্য এ শিক্ষা হলো, জাতীয় নিরাপত্তা, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ঐক্য ও কৌশলগত প্রজ্ঞা ছাড়া কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। আমরা যদি আজই সঠিক পদক্ষেপ না নিই, তবে বৈশ্বিক সংঘাতের ঢেউ আমাদের তীরেও আছড়ে পড়বে। কিন্তু সময়মতো প্রস্তুত হলে সংকটকে সুযোগে রূপান্তর করাও সম্ভব।
 

লেখক: গবেষক ও সামাজিক চিন্তক

মাতৃভূমির খবর

Link copied!