প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ১১:৪০ এএম
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ুপ্রবণ দেশ। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অভিঘাতে এই দেশের ভবিষ্যৎ প্রতিদিনই আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বড় অংশ পানির নিচে ডুবে যাবে, কোটি মানুষ হয়ে উঠবে জলবায়ু উদ্বাস্তু। অথচ বাংলাদেশ দায়ী নয়—কার্বন নিঃসরণে দেশের অবদান মাত্র ০.৪ শতাংশ, কিন্তু ভোগান্তি সর্বাধিক।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) পূর্বাভাস অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি ডুবে যাবে। এতে কমপক্ষে তিন কোটি মানুষকে গৃহহীন হতে হবে। বর্তমানে খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও ভোলার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ লবণাক্ত পানির দুঃসহ পরিস্থিতিতে বসবাস করছে। কৃষিজমি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, পানীয় জলের সংকট তৈরি হচ্ছে, মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু পরিবর্তিত আবহাওয়া ফসল উৎপাদনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। খরা, অনিয়মিত বর্ষা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এবং লবণাক্ততার কারণে উৎপাদন কমছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (IFPRI) এর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে চাল উৎপাদন কমে যেতে পারে ১৫ শতাংশ, গম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুধু ধান উৎপাদনেই প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ টনের ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থায় খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে, যা দেশের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে মানুষের স্থানচ্যুতি। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু ঢাকায় আশ্রয় নিচ্ছে। ঢাকার মোট বস্তিবাসীর প্রায় ৩০ শতাংশই উপকূলীয় অঞ্চল থেকে আসা। ২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে তিন কোটি ৫০ লাখে, যার একটি বড় অংশ হবে জলবায়ু উদ্বাস্তু। এটি নগর অবকাঠামো, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা—সবকিছুর উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে। সামাজিক বৈষম্য বাড়বে, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব আরও প্রকট হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের রফতানির ৮৪ শতাংশ যোগান দেয়। এই খাত জলবায়ুর কারণে হুমকির মুখে। বন্যা, বিদ্যুৎ সংকট ও কাঁচামালের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (ADB) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জিডিপি ৬.৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। শুধু পোশাকশিল্প নয়, কৃষি, মৎস্য ও চামড়া শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের এই ভোগান্তির মূল দায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলো বিশাল হারে কার্বন নিঃসরণ করছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উন্নত দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে। কিন্তু বাস্তবে এ অর্থের অর্ধেকও এখনো পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের শীর্ষে থাকলেও প্রকৃত অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তরে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ঘোষণা করেছে। এতে পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষি উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দুর্যোগ মোকাবিলার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনা হবে। ইতিমধ্যে ২০০টিরও বেশি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৭ শতাংশ, যা যথেষ্ট নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল সরকারি উদ্যোগে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশবান্ধব জীবনধারায় অভ্যস্ত হতে হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার কমানো, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, বনভূমি রক্ষা ও সচেতনতা তৈরি—সবক্ষেত্রেই নাগরিক অংশগ্রহণ জরুরি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্ব জলবায়ু আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে, যা আশার আলো জাগায়।
বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন শুধু পরিবেশগত নয়, এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটও বটে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ সংস্কার, উন্নত বিশ্বের সহায়তা এবং বৈশ্বিক ন্যায্যতা অপরিহার্য। আজকের পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে। আমরা যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচতে হবে আরও ভয়াবহ দুর্যোগ ও বৈষম্যের মধ্যে।