প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৫, ০৮:০৩ পিএম
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারা দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শাটডাউন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) বিকেলে ডিএমপি কার্যালয় অভিমুখে মিছিল শেষে ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশনে সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিএসসিদের ৩টি দাবির কথা জানানো হয়। এগুলো হলো: ৩৩ শতাংশ পদোন্নতি কোটা অযৌক্তিক, টেকনিক্যাল গ্রেড উচ্চতর যোগ্য প্রার্থীর জন্য উন্মুক্তকরণ এবং বিএসসি ছাড়া কেউ ইঞ্জিনিয়ার পদবি ব্যবহার করতে পারবে না।
এ সময় বলা হয়, পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে ক্যাম্পাস শাটডাউন বলবৎ থাকবে, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে বিভাগীয় প্রকৌশলী সমাবেশ করা হবে এবং সপ্তাহব্যাপী বিভাগীয় সমাবেশ শেষে প্রকৌশলীদের জাতীয় সমাবেশ করা হবে। যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে।
প্রকৌশলী অধিকার পরিষদের উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান শহিদ বলেন, রংপুরে হুমকির ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ছাত্রদের ওপর হামলার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উপদেষ্টারা কোনো ব্যবস্থা নেননি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন্স ফ্রেমওয়ার্কের (বিএনকিউএফ) মাধ্যমে শিক্ষাগত যোগ্যতার মান নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে একই পদ্ধতি। ডিপ্লোমাধারীরা চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে বিএসসির যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। অর্থাৎ শুধু অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লেভেল ৬ (ডিপ্লোমা) থেকে লেভেল ৭ (বিএসসি, যা নবম গ্রেডের জন্য বাধ্যতামূলক) যাওয়ার সুযোগ নেই।
পূর্বঘোষিত ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার (২৭ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা শাহবাগের মূল সড়কে অবস্থান নেন। এতে শাহবাগ ও আশপাশের সব সড়ক অচল হয়ে পড়ে। দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা যমুনা অভিমুখে অগ্রসর হলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানেগ্যাস ও জলকামান নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।
পরে রাতে ‘প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন’ প্ল্যাটফর্ম থেকে শাটডাউন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে বলা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), চুয়েটসহ অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচি চলবে।
তবে বুয়েট বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটির কারণে বন্ধ ছিল। খুলনা ও সিলেট প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয়েছে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন এই কর্মসূচির সমর্থনে নির্ধারিত পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বুয়েটের বেশ কয়েকটি বিভাগে কাউকে দেখা যায়নি।
বুয়েটে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী নাসিমুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি। তবে শুক্রবার ছাড়া বাকি সব দিন আমাদের পরীক্ষা হয়। আমাদের আজকের পরীক্ষা আমরা বয়কট করেছি।
সকাল ১০টায় সরেজমিনে বুয়েটের বেশ কয়েকটি বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, কোথাও শিক্ষার্থীরা আসেননি। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনের নিরাপত্তারক্ষী গোলজার হোসেন বলেন, আজকে এমনিই বুয়েটে সাপ্তাহিক বন্ধ। কেউ তো আসবে না।
অন্যদিকে, বুধবার রাতে বুয়েট কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক জরুরি নোটিশে স্নাতক পর্যায়ের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে।
বুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. এন এম গোলাম জাকারিয়ার সই করা নোটিশে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে ৩০ আগস্ট থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত সব স্নাতক পরীক্ষা স্থগিত করা হলো।
বুয়েটের সহকারী রেজিস্ট্রার আলী আশরাফ বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, বৃহস্পতিবার বুয়েটে সাপ্তাহিক ছুটি, তাই এদিন কোনো ক্লাস-পরীক্ষা নেই।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মাহবুবুল আলম বলেন, শাটডাউনের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। তাই ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ ছিল।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রকৌশল ও কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বিজ্ঞান ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থীরা। পরে কৃষি অনুষদের চার বিভাগের শিক্ষার্থীরা এতে সংহতি জানায়।
অবস্থান কর্মসূচি শেষে দুপুর ১টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে রাবি প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করে সমাবেশ করেন তারা। আধা ঘণ্টা অবস্থান শেষে কর্মসূচি সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দিব না’, ‘কৃষিবিদ আসছে রাজপথ আসছে’, ‘নবম দশম পরে কর ইঞ্জিনিয়ার বানান কর’, ‘প্রকৌশলীদের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়িনাই’।
শাখা প্রকৌশল অধিকার আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক সিফাত আবু সালেহ বলেন, বুধবার লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে পুলিশের ন্যাক্কারজনক হামলায় আমাদের বহু সহপাঠী আহত হয়েছেন, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বারবার উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। যে দেশ প্রকৌশলীদের মর্যাদা দিতে ব্যর্থ, সে দেশ কখনো উচ্চশিখরে পৌঁছাতে পারবে না।
প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থী আহমেদ হাসান বলেন, সরকার আমাদের তিন দফা দাবিকে শুরু থেকেই উপেক্ষা করছে। ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির সময় পুলিশ আমাদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে।
এর আগে গতকালও রাবি-রুয়েট শিক্ষার্থীরা তালাইমারি মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এছাড়াও ২৪ আগস্ট রুয়েট, রাবি ও পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই দাবিতে দুই ঘণ্টা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ইলেক্ট্রিকাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক বশির আহমেদ বলেন, রুয়েটে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি। ছুটির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার কোনো ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এদিন অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলেছে বলে জানান অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার কামাল আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে না বলে কোনো তথ্য আমার কাছে আসেনি।
ঢাকায় প্রকৌশলী শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে এদিন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অন্তর্বর্তী সরকারের ‘গায়েবানা জানাজা’ পড়েন। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে এসব কর্মসূচি পালন করেন তারা।তারা চলমান তিন দফা দাবি আদায়ে তাদের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে পুলিশি হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গায়েবানা জানাজাও আদায় করেছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, তাদের ন্যায্য দাবি দমাতে পুলিশের হামলা হয়েছে। তারা বলেন, যতদিন পর্যন্ত দাবি মানা না হবে, আমরা ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরব না। প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে শিক্ষার্থীরা বলেন, মেধাকে মূল্যায়ন না করে কোটাকে অগ্রাধিকার দিলে ছাত্রসমাজ চুপ করে থাকবে না। মনে রাখবেন, ছাত্রসমাজ ’৫২, ’৭১ কিংবা ’২৪ এ হারেনি-২৫ এ এসেও হারবে না।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ছাত্রকল্যাণ পরিচালক বি এম ইকরামুল হক দুপুরে বলেন, আমাদের ছাত্ররা প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের দাবি সঙ্গে একমত, তবে কুয়েট যেহেতু বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন; তাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। সে অনুযায়ী তারা বৃহস্পতিবার ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন।