জীবন সালেহিন
প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৫, ১১:৪৭ এএম
বাংলাদেশে ভূমিদস্যুতা আজ এক ভয়াবহ মহামারীর রূপ নিয়েছে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র সাধারণ মানুষ ভিটেমাটি হারাচ্ছে দখলদার চক্রের হাতে। নদী-খাল-জলাশয় বেদখল, কৃষিজমি দখল কিংবা ভুয়া দলিল তৈরি—সব মিলিয়ে ভূমিদস্যুতা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতীয় উন্নয়ন, পরিবেশ ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বক্তব্যে নতুন আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন—ভূমিদস্যুদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না; সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে তথ্যদাতাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা নিঃসন্দেহে সাহসী ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ।
জাতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়—ঢাকার আশপাশে গত এক দশকে প্রায় ১২ হাজার একর কৃষিজমি ভূমিদস্যুদের দখলে চলে গেছে (প্রথম আলো, জুলাই ২০২৩)। একইভাবে ডেইলি স্টার উল্লেখ করেছে, কেবল কেরানীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ এলাকাতেই অন্তত ৫০টি খাল দখল হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা জানিয়েছে, ঢাকার প্রায় ৭০ শতাংশ খাল ও জলাশয় আংশিক বা পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে। এসব পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে, ভূমিদস্যুতা এখন আমাদের জাতীয় সংকট।
আন্তর্জাতিকভাবে এই অপরাধকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০১২ সালে প্রকাশিত নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, ভূমিদস্যুতা দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়ায়, সামাজিক সংঘাত উসকে দেয়। ভারতে Benami Transactions (Prohibition) Act, 2016–এর আওতায় ভুয়া মালিকানার নামে জমি দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশটিতে প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৪,৩০০ কোটি রুপির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আফ্রিকার কেনিয়ায় ২০১৬ সালের Land Laws (Amendment) Act দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করেছে। উগান্ডায় ২০১০ সালের Land Amendment Act অনুযায়ী জমি দখলের অপরাধে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এসব আন্তর্জাতিক উদাহরণ প্রমাণ করে—ভূমিদস্যু দমন কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয় নয়, বরং এটি মানবাধিকার ও ন্যায্যতার প্রশ্ন।
বাংলাদেশ সরকারও ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ডিজিটাল খতিয়ান, অনলাইন রেকর্ড সিস্টেম, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা ইতিবাচক। তবে বাস্তবায়নে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব এবং দীর্ঘসূত্রতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ঘোষণার গুরুত্ব এখানেই—তিনি প্রথমবারের মতো সরাসরি জনগণকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পিস্তলের তথ্যের জন্য ৫০ হাজার টাকা, চায়না রাইফেলের জন্য ১ লাখ, এসএমজির জন্য দেড় লাখ, এলএমজির জন্য ৫ লাখ এবং প্রতিটি গুলির তথ্যের জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কার্যকর কৌশল।
তবে শুধু ঘোষণায় কাজ শেষ হবে না। ভূমিদস্যু দমনে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে—
১. দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিশেষ কোর্টে মামলা নিষ্পত্তি।
২. তথ্যদাতা সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৩. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে আরও সক্রিয় করা।
৪. সম্পূর্ণ ডিজিটাল রেকর্ড সিস্টেম চালু করে ভুয়া দলিলের সুযোগ বন্ধ করা।
এখনই সময় রাষ্ট্র ও সমাজ সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করুক—ভূমিদস্যুদের আর কোনো ছাড় নয়। এ জন্য সরকারের দৃঢ় মনোভাবকে সাধুবাদ জানাতে হয়। যদি এই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হয়, তবে আমরা ভূমিদস্যু মুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হব, যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের ভিটেমাটি ও অধিকার নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে।
লেখকঃ গবেষক ও সামাজিক চিন্তক
মাতৃভূমির খবর