বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২৫

জনগণের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন: গণপিটুনি বনাম ন্যায়বিচার

জীবন সালেহিন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৪, ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম

জনগণের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন: গণপিটুনি বনাম ন্যায়বিচার

ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল

বাংলাদেশে আজকের সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি হলো গণপিটুনি বা হাতুড়ি বিচার। আইনের শাসনের পরিবর্তে যখন জনতা নিজেরাই বিচারক হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের জন্যই এটি হয়ে দাঁড়ায় এক ভয়াবহ বিপদ। গত এক বছরে ৬৩৭ জন মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন—সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো ও সামাজিক আস্থার গভীর ভাঙনের প্রতিফলন।

শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের মানুষ ভেবেছিল গণতন্ত্রের এক নতুন সূচনা হবে। জনগণ আশা করেছিল জবাবদিহিমূলক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে আদালতের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে, বিচারব্যবস্থার গতি শ্লথ হয়ে গেছে, আর মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় অপেক্ষা না করে ক্ষণিক উত্তেজনায় নিজেরাই শাস্তি দিতে শুরু করেছে। ফলে “ন্যায়বিচার” অনেক সময় নিষ্ঠুর প্রতিশোধে রূপ নিচ্ছে, যেখানে অপরাধী–নিরপরাধ কেউই সুরক্ষিত নয়।

এখানে প্রশ্ন আসে—মানুষ কেন এ পথে যাচ্ছে? প্রথমত, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দমননীতি এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা মানুষকে হতাশ করেছে। বহু অপরাধী বা ক্ষমতাসীনদের দোসররা বছরের পর বছর বিচার এড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, পুলিশ ও প্রশাসনের দুর্বলতা মানুষের মনে গভীর আস্থার সংকট তৈরি করেছে। গ্রেফতার করলেও মামলার জটিলতা, দুর্নীতি কিংবা প্রভাবশালী মহলের চাপে অনেকেই আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক ক্ষোভ মানুষের মনে এমন এক মানসিকতা তৈরি করেছে, যেখানে তারা মনে করে আইনের চেয়ে নিজের হাতে বিচার করাই অধিক কার্যকর।

কিন্তু এই প্রবণতা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক একটি সংকেত। গণপিটুনি কখনোই ন্যায়বিচার নয়; বরং এটি আরেকটি অপরাধ। আজ অপরাধীকে পেটানো হচ্ছে, কাল হয়তো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, পরশু হয়তো ব্যক্তিগত শত্রুকে। এই চক্র চলতে থাকলে সমাজ দ্রুত অরাজকতার দিকে ধাবিত হবে। আইনের শাসনের অভাবে মানুষের মৌলিক নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক অধিকার দুটোই বিপন্ন হবে।

এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় স্তরে পদক্ষেপ নেওয়া। প্রথমত, আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানুষ দেখতে পায়, অপরাধ করলে শাস্তি অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যকর করা জরুরি। জনগণকে অভিযোগ জানাতে হবে আইনের আওতায় থেকে—নিজেদের হাতে লাঠি তুলে নিয়ে নয়। তৃতীয়ত, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। গণপিটুনি কোনো ন্যায়বিচার নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সহিংসতাকে বৈধতা দেয়—এই বার্তাটি প্রচার করতে হবে গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও দায়িত্ব নিতে হবে। আইনের বাইরে কোনো বিচার গ্রহণযোগ্য নয়—এই স্পষ্ট বার্তা নেতৃত্বকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। কারণ জনগণ যখন দেখে রাজনৈতিক শক্তিগুলোও আইনকে উপেক্ষা করছে, তখন সাধারণ মানুষও নিজেদের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা অনুভব করে।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, গণপিটুনি জনগণের শক্তি নয়, এটি দুর্বল রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।

আইনের শাসনই গণতন্ত্রের আত্মা। সেই আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করার এখনই সময়। কারণ জনগণের হাতে বিচার নয়, রাষ্ট্রের হাতে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনাই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।

লেখক: গবেষক ও সামাজিক চিন্তক

মাতৃভূমির খবর

Link copied!