জীবন সালেহিন
প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৫, ০৩:৪৪ পিএম
গণতন্ত্র কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়; এটি একটি বিশ্বাস, একটি আস্থা। জনগণ রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক—এ ধারণা থেকেই গণতন্ত্রের জন্ম। আর সেই আস্থার মূল স্তম্ভ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন। সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন না হলে গণতন্ত্রের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ কথাটি এখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপোড়েন এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতা এক ভয়াবহ অচলাবস্থার জন্ম দিচ্ছে। প্রশ্ন জাগছে—গণতন্ত্রের জন্য আদৌ আমাদের হাতে সময় আছে কি?
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে টালমাটাল পরিস্থিতির অভাব নেই। একদিকে ক্ষমতাসীনদের অতিরিক্ত প্রভাব খাটানো, অন্যদিকে বিরোধী দলের অনমনীয় অবস্থান—সব মিলিয়ে প্রতিবারই জনগণকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। নির্বাচন পিছিয়েছে, ভোটাররা আস্থা হারিয়েছে, কখনো সহিংসতায় প্রাণও হারিয়েছে নিরীহ মানুষ। অথচ জনগণের ভোটাধিকার হলো সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। নির্বাচন যদি নিয়মিত, নির্দিষ্ট সময়ে এবং নিরপেক্ষভাবে না হয়, তবে গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়।
এখনকার পরিস্থিতি তাই আরও উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই সনদ নিয়ে মতবিরোধ স্পষ্ট। একপক্ষ চাইছে শর্তসাপেক্ষে এগোতে, অন্যপক্ষ চাইছে বিলম্ব করতে। ফলে যে প্রক্রিয়া আজ শুরু হওয়ার কথা, তা কাল পিছিয়ে যাচ্ছে, আবার পরশু অচলাবস্থায় আটকে যাচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতায় সাধারণ মানুষ যে হতাশ হয়ে পড়ছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই হতাশা যখন রাজনীতির প্রতি অবিশ্বাসে রূপ নেয়, তখন রাষ্ট্রের জন্য সেটি ভয়াবহ সংকেত।
বিলম্বের ফলে কেবল রাজনৈতিক স্থবিরতা তৈরি হয় না, অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় পড়ে, কর্মসংস্থান থমকে যায়, বাজারে অস্থিরতা বাড়ে। সমাজে অশান্তি তৈরি হয়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি, বেকারত্ব ও বৈষম্যের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা যুক্ত হয়, তবে তা জনগণের জীবনে আরও দুর্ভোগ বয়ে আনবে।
এখন প্রশ্ন হলো, এর দায় কার? শুধু একটি দলের নয়, বরং সব রাজনৈতিক শক্তিরই সমান দায় রয়েছে। গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা কোনো একক দলের দায়িত্ব নয়, এটি সমষ্টিগত দায়বদ্ধতা। সরকার যেমন ক্ষমতার প্রভাব খাটানো থেকে বিরত থাকবে, তেমনি বিরোধী দলও গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নেবে—এটাই প্রত্যাশিত। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান ও রাষ্ট্রের স্বার্থকে ক্ষমতার স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান না দেয়, তবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এ অবস্থায় প্রয়োজন একটি জাতীয় ঐকমত্য। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও প্রক্রিয়া নিয়ে একটি সমঝোতা জরুরি। জনগণ যে শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও সময়োপযোগী নির্বাচন চায়, সেটিই রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার হতে হবে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিই নয়, বরং একটি নৈতিক দায়বদ্ধতা। কারণ ক্ষমতা আসে-যায়, কিন্তু জনগণের আস্থা হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।
আমার কাছে মনে হয়, এখনই সময় রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মসমালোচনা করার। উন্নয়নের বাহারি পরিসংখ্যান, বড় বড় প্রকল্প বা কাগুজে প্রতিশ্রুতিতে জনগণের আস্থা ফেরানো যাবে না। আস্থা ফিরবে তখনই, যখন ভোটাররা বুঝতে পারবে তাদের ভোটের মূল্য আছে, তাদের মতামতই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।
গণতন্ত্রের স্বার্থে সময়মতো নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই। প্রতিটি বিলম্ব, প্রতিটি অজুহাত গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা দরকার, আর স্থিতিশীলতার জন্য দরকার রাজনৈতিক স্বচ্ছতা। আমরা যদি বারবার বিলম্ব করি, তবে একসময় হয়তো গণতন্ত্রের চাকা থেমে যাবে। আর তখন সেটি আবার চালু করা সহজ হবে না।
ন্যায়, নিরাপত্তা ও নৈতিকতার মতোই গণতন্ত্রও কোনো বিলাসিতা নয়—এটি নাগরিক জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাই প্রশ্নটি আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক: নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিলম্বের বিলাসিতা আমাদের হাতে আর কতটুকু আছে?
লেখকঃ গবেষক ও সামাজিক চিন্তক
মাতৃভূমির খবর