শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর, ২০২৫

সুদ না থাকলে পৃথিবী কেমন হতো?

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১১:২০ এএম

সুদ না থাকলে পৃথিবী কেমন হতো?

ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল

মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিদিন যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে হাঁটি, তার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে একটি পাতলা কাগজ বা স্ক্রিনে ভেসে থাকা কয়েকটি ডিজিট—টাকা। এই টাকার সঙ্গে আমাদের শৈশব, পড়াশোনা, চিকিৎসা, বিয়ে, বার্ধক্য—সবকিছুর সুতো বাঁধা। অথচ টাকার স্বরূপ সম্পর্কে আমরা যতটা ভাবি, ততটা ভাবি না বাতাস নিয়ে—যা ছাড়া বাঁচা যায় না। টাকা, সুদ, ইনফ্লেশন, গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড, ব্যাংকিং, “মানি মাস্টারস”, বিশ্ব রাজনীতি, জেকিল আইল্যান্ডের গল্প, এমনকি দান-যাকাত আর মসজিদের ব্যয়সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে একটি বড় প্রশ্ন শক্ত হয়ে দাঁড়াল: সুদ না থাকলে পৃথিবী কেমন হতো?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আগে বুঝতে হয়—সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে, কারা এতে লাভবান হয়, কার পকেট ফাঁকা হয়; এবং তার বিপরীতে সুদহীন সমাজ কীভাবে মানুষের স্বাধীনতা, সম্পত্তির নিরাপত্তা, দুর্নীতি-অপরাধ, এমনকি আমাদের নৈতিকতা—সবকিছু বদলে দিতে পারে। এই কলামে আমি আলাপের সুতোগুলোকে জুড়ে দিয়ে একটি মানবিক, সরল কিন্তু গভীর ছবি আঁকতে চাই।

প্রথমেই, কাগজ—এটি খারাপ না ভালো—এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি অনেক। কাগজ টাকা নিজে কোনো পাপ নয়, আবার কোনো পুণ্যও নয়। কাগজ ‘খারাপ’ হয় তখন, যখন তার পেছনে কোনো বাস্তব সম্পদের রেফারেন্স থাকে না, যখন তাকে ‘আইনগত দরপত্র’ (legal tender) বানিয়ে—“এটাতেই কর দাও, এটাতেই লেনদেন কর”—এই বলে আপনাকে বাধ্য করা হয়, এবং যখন কাগজের সংখ্যা ‘উৎপাদন’ নয়, বরং ‘প্রিন্ট’ করে ইচ্ছেমতো বাড়ানো যায়। এই প্রিন্টিং বা সৃজিত ডিজিট যখন প্রথমে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের দরজায় টোকা দেয়, তখন বাজারে ঢোকার প্রথম সুবিধা তারা পায়; আর দাম বাড়ার ‘শেষ ধাক্কা’টা খায় সাধারণ মানুষ। ইনফ্লেশনকে তাই বলা যায় অদৃশ্য কর—যার কোনো সংসদীয় বিতর্ক লাগে না, জনগণের অনুমতিও লাগে না; তবু মানুষের পকেট থেকে সম্পদ চুপিসারে সরে যায়।

একসময় সোনাদানা ছিল—বহন-নিরাপত্তার অসুবিধা ছিল বলে ‘রসিদ’ চালু হলো; রসিদ চলতে চলতে ‘ডলার’ বা অন্য নোট হলো; এবং সেই নোটের উপর লেখা থাকত, “অমুক আউন্স সোনার প্রতিনিধিত্ব করে”—মানে, চাইলে সোনা পাওয়া যাবে। এটিই ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’। এক জায়গায় সোনা জমা—মানুষ কাগজে লেনদেন। কাগজ তখন শুধু দলিল। সমস্যা শুরু হলো যখন কাগজ থেকে সোনার সম্পর্ক কেটে দেওয়া হলো—কাগজ হলো কাগজই; তার মান এখন নির্ভর করবে “কে ইস্যু করল, কতটা ইস্যু করল, বাজারে কার হাত প্রথমে লাগল”—এই জটিল নীতির ওপর। অর্থনীতির বইতে এটিকে বলা হয় “ফিয়াট মানি”—অন্তর্নিহিত মান শূন্য, কিন্তু আইনি আদেশে তা টাকা। এর পরিণাম? আপনি আপনার শ্রম দিয়ে মূল্য তৈরি করেন; অথচ ‘মানি ক্রিয়েশনের’ ক্ষমতাধারীরা—কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক—ঋণ ও সুদের চক্রে বসে মূল্য স্থানান্তরের খেলায় জিতে যায়।

আমরা প্রায়ই জিজ্ঞেস করি—“ব্যাংক তো ১২% সুদে ঋণ দেয়, ৮–৯% দেয় আমানতে—ভাগে-ভাগে খরচ বাদ দিলে তাদের লাভ কই?” উত্তর আছে মানি-ক্রিয়েশনের প্রক্রিয়ায়। ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং—অল্প রিজার্ভে বহু গুণ টাকা তৈরি। এই নতুন টাকার সঙ্গে যুক্ত হয় সুদ। ফলে সমাজে এমন কোনো টাকা থাকে না, যার পেছনে সুদের দাবি নেই। নতুন টাকা মানে নতুন দাবি; কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সুদের টাকা কেউই তৈরি করে না—এই ঘাটতি পূরণ হয় আবার নতুন ঋণে। এভাবে অর্থনীতি পরিণত হয় গ্ল্যাডিয়েটর অ্যারেনা—যেখানে “হারলে অপমান-দেউলিয়াত্ব”—ভয়ের সংস্কৃতি ব্যবসায়িক নীতি, মানুষে-মানুষে আস্থা, ন্যায়-অন্যায় সবকিছুকে গিলে খায়। আপনি মাপ-ওজনে কম দেবেন না কেন? আপনারও তো সুদ মেটাতে হবে! আপনি ঘুষ নেবেন না কেন? না হলে আপনি খেলা থেকে ছিটকে যাবেন!

এখানেই সুদের সাথে নৈতিকতার যোগ। কুরআন বলে—“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন আর দানকে বাড়িয়ে দেন।” সুদ একদিকে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ঘটায়, অন্যদিকে মানুষের হৃদয়ে কৃপণতার দর্শন ঢুকিয়ে দেয়: “আমার টাকা থেকে আরো টাকা চাই।” এটি যাকাতের বিপরীত দর্শন—যেখানে টাকা ছাড়লে সমাজে বরকত নামে। সুদ মুছে দেয় মানুষের ‘হক’-এর ধারণা; যাকাত সেটিকে ফিরিয়ে আনে—“এটা গরিবের অধিকার, ধনীর দয়া নয়।”

এখানেই দাঁড়িয়ে আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়নাতেও নিজেদের দেখা জরুরি। যদি সমাজের অর্থনৈতিক চেতনা পুঁজিবাদী-ভোগবাদী পথে ছুটে, তবে মসজিদ-মাদ্রাসার ভেতরও প্রভাব পড়ে। ঝাড়বাতি-টাইলস-এসি বাড়ে; কিন্তু দরজার বাইরে যে ক্ষুধার্ত, যে ছাত্রের বই নেই, যে রুগীর ওষুধ লাগবে—তাদের কাঁধ পর্যন্ত হয়তো পৌঁছায় না আমাদের দান। কোরআন যে দানের টার্গেট স্থির করেছে—এতিম, মিসকিন, ঋণগ্রস্ত—সেখানে ফিরে না গেলে, ঈমানের আলো নেমে আসে কংক্রিটের ঠান্ডা ঝিলিক হয়ে। সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবাহকে যদি আমরা ধর্মীয় অনুষঙ্গে পুনরায় ‘পবিত্র’ করে তুলি, তবে সমাজ বদলায় না; বদলায় শুধু মিনারের উচ্চতা।

বিশ্ব রাজনীতির প্রসঙ্গ না তুললে কথাটা সম্পূর্ণ হয় না। ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে ডলারে ক্ষমতাকেন্দ্র স্থানান্তর—ব্রেটন উডস, “ডলার রিজার্ভ কারেন্সি”—সবই ইতিহাস। জেকিল আইল্যান্ডের গল্প হোক, বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ব্যক্তিগত মালিকানার রহস্য—এ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, গবেষণা চলতে পারে। কিন্তু বড় চিত্রটি স্পষ্ট: কারেন্সির নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ গল্পের কলম যার হাতে, কাহিনি সে-ই লেখে। আপনি যদি বলেই দেন, “আমার মুদ্রাই সবার মুদ্রার মাপকাঠি, আমার মুদ্রাতেই কর, আমদানি-রপ্তানি, ঋণ”—তাহলে বৈশ্বিক রাজনীতির স্টিয়ারিংও আপনার হাতে চলে আসে। যারা এই খেলায় দ্বিমত পোষণ করে—কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা খায়, কেউ সামরিক চাপ। “যুদ্ধ হয়নি, তবু ক্ষমতাকেন্দ্র বদলে গেল”—কারণ রসুনের গোড়া (মুদ্রা-শক্তি) একই জায়গায়—শুধু সাইনবোর্ড পাল্টেছে।

সবশেষে, আসল প্রশ্নে ফিরি: যদি সুদ না থাকত, পৃথিবী কেমন হতো?
চলুন, কল্পনার বদলে নীতিগত বাস্তবতা দিয়ে ছবিটা আঁকি—

এক. সম্পত্তির নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি।
ইসলাম সম্পত্তির হককে পবিত্র করেছে। চুরি, দস্যুতা, জবরদখল—এগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিয়েছে; এতিমের সম্পদ গ্রাসকে “আগুন খাওয়া” বলা হয়েছে। সুদহীন ব্যবস্থায় পুরস্কার-শাস্তির ন্যায়সংগত প্রয়োগ হলে রাতের ঘুমে আপনার বাড়ির দরজা, আপনার গরু-ছাগল, আপনার মোটরসাইকেল—সবকিছু নিয়ে উদ্বেগ কমে যাবে। Security reduces transaction cost. ব্যবসা সহজ, জীবন শান্ত।

দুই. ক্ষুধামুক্ত সমাজের দিকে যাত্রা।
যাকাত-সদকা-উকুফ—এসব কেবল ধর্মীয় শব্দ নয়; এগুলো সিস্টেম ডিজাইন। কৃষিপণ্যে উশর, পণ্যে যাকাত, নগদে যাকাত, ইনভেন্টরিতে যাকাত—এই নেটওয়ার্ক সচল থাকলে দেশে খাদ্যাভাব পদ্ধতিগতভাবে কমে যায়। ফার্মেসিগুলোর ‘যাকাত ইন কাইন্ড’ হলে কত অসহায় মানুষ নিয়মিত ওষুধ পেত! আর ঋণগ্রস্ত সদাচারীর বেইলআউট—ইসলাম এটিকে ব্যক্তির অধিকার বানিয়েছে, শাসকের দায়িত্ব বানিয়েছে। এখানে দয়া নয়, হক—যে শব্দ মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়।

তিন. বৈষম্য সংকোচন ও সামাজিক আস্থা।
সুদ সম্পদকে চক্রবৃদ্ধিতে একদিকে টেনে নেয়; যাকাত-মহাসড়ক সেটিকে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়। ফলে কেবল ধনী-গরিব নয়, শক্তি-দুর্বল, শহর-গ্রাম, কেন্দ্র-প্রান্ত—সবখানে আস্থার সেতু তৈরি হয়। সুদহীন উদ্যোক্তা কাঠামো—মুদারাবা-মুশারাকা—লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগি শেখায়; এতে risk ভাগ হয়, rewardও ভাগ হয়। “দোকানদার আমাকে ঠকাবে”—এই অবিশ্বাস কমে; আপনি ওজন-দামে সৎ থাকলে টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

চার. দুর্নীতি ও অপরাধে কাঠামোগত চাপ কমে।
যখন সমাজের সব টাকা ঋণ এবং ঋণের সাথে ‘অতিরিক্ত’ ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা, তখন সমাজ ব্যবসার খেলাঘর নয়, বরং বেঁচে থাকার রণক্ষেত্র হয়ে যায়। সেখানে নিয়মভাঙা, ঘুষ, ছলনা—সব ‘ব্যবসায়িক বাস্তবতা’। সুদ মুছে গেলে বেঁচে থাকার খেলাটি সহজ হয়; নিয়ম মানার খরচ কমে; অপরাধের প্রলোভনও কাঠামোগতভাবে হ্রাস পায়।

পাঁচ. উদ্ভাবন ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা।
আজ আপনি স্টার্টআপ আইডিয়া নিয়ে দাঁড়ালেন; সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুদখোর মূলধনের পাহাড়—বড় কোম্পানি ব্যাংক ঋণ তুলে আপনার আইডিয়াকে গ্রাস করল, আপনাকে ফেলে দিল। লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির বিনিয়োগ সংস্কৃতি এলে—ইক্যুইটির মাধ্যমে অংশীদারিত্ব বাড়লে—বুদ্ধি ও সৃজনশীলতা মূলধনের কাছে বন্দি থাকে না; মূলধনই আসে বুদ্ধির কাছে। এতে ন্যায্য প্রতিযোগিতা জন্ম নেয়।

ছয়. রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্কের নৈতিকতা।
সুদভিত্তিক ফিয়াট ব্যবস্থায় সরকার চাইলে ‘কর ছাড়াই কর’ নিতে পারে—মুদ্রা ছাপিয়ে। সুদহীন, জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থায় কর-ব্যয় জনগণের অনুমতি ও তদারকির মধ্য দিয়ে হয়; ‘মুদ্রা’ শাসকের খেয়ালখুশির নয়, আমানত। ফলে গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারও শক্ত হয়।

এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন—“তা হলে কি উন্নয়ন হবে না? চওড়া রাস্তা, উঁচু ভবন, আধুনিক হাসপাতাল?” হবে, কিন্তু মানুষকে কেন্দ্র করে—ভোগকে নয়। রাস্তা-সেতু হবে মানুষের যাতায়াতে, কিন্তু সেই সাথে হবে খাদ্য-নিরাপত্তা, চিকিৎসা-অধিকার, শিক্ষা-মানবিকতা। উন্নয়ন ‘চকচকে ছবি’ নয়; উন্নয়ন হলো মানুষের মাথায় শান্তির বালিশ

এই ছবিটা আঁকতে গিয়ে বারবার মনে পড়েছে—আমরা কত সহজে মূল কারণটা দেখি না। ঘরে সাপ দেখা গেলেই আমরা সাপটাকে দোষ দেই, কিন্তু বাসাটা যে আছে—দেয়ালের ভেতর, চালার খাপে—তা দেখার চোখ গড়ে ওঠে না। সুদ সেই বাসা—যেখান থেকে বিষ বেরিয়ে সমাজজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা বিষের লক্ষণ দেখি—দুর্নীতি, অপরাধ, পারিবারিক ভাঙন, মানসিক চাপ, প্রতিযোগিতার অমানবিকতা—কিন্তু বাসা ভাঙি না। ফলে বিষ থামে না।

আরেকটি কথা না বললেই নয়—বিশ্ব রাজনীতিতে যে ‘সুপার পাওয়ার শিফট’ আমরা দেখি, তার পেছনে টেকনোলজি বা সামরিকশক্তির চেয়েও বড় চালিকাশক্তি হলো মুদ্রাশক্তি। ব্রিটিশ পাউন্ড থেকে ডলারে, আগামীতে হয়তো অন্য কোথাও—সাইনবোর্ড বদলায়, গোড়া থাকে একই জায়গায়, যদি মানি-পাওয়ার একই হাতেই থাকে। তখন আপনি যে-ই হন—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া, সংস্কৃতি—সব জায়গায় টাকার দর্শন, অর্থাৎ সুদের দর্শন, ঢুকে পড়ে; এবং তার সাথে ঢুকে পড়ে ‘মনের দাসত্ব’। মানুষ ভাবে—“সুদ ছাড়া দুনিয়া চলে না”—যেন কুফরের ‘ইসলামিক ভার্সন’ চাই! অথচ রাসুল আমাদের শিখিয়েছেন—হারাম জিনিসের ‘হালাল সংস্করণ’ নেই; আছে কেবল ত্যাগ করে হালাল বিকল্প গঠন। অর্থনীতি তার ব্যতিক্রম নয়।

তাহলে, সামনে পথ কী?
পথ দুটি—একদিকে সুদের দাসত্ব, যেখানে ইনফ্লেশন ও ঋণ আমাদের শ্রমকে নিঃশব্দে লুট করে; অন্যদিকে আল্লাহর হুকুম, যেখানে দান-যাকাত-মুহাব্বত সমাজকে জীবন্ত রাখে। ব্যক্তির স্তরে—সুদভিত্তিক লেনদেন এড়িয়ে চলা, হালাল উপার্জন ও ব্যয়ে স্থির থাকা, যাকাত-সদকা নিয়মিত করা, ঋণগ্রস্তকে ত্রাণ দেওয়া, মসজিদে ‘আড়ম্বর’ কমিয়ে মানুষের ওপর ব্যয় বাড়ানো। প্রতিষ্ঠানের স্তরে—লাভ-ক্ষতি ভাগাভাগির ভিত্তিতে বিনিয়োগ, সুদবিহীন সঞ্চয় ও অর্থায়নের মডেল, সামাজিক ব্যবসা। রাষ্ট্রের স্তরে—মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিকে স্বচ্ছ জবাবদিহির ছায়ায় আনা, দান-উকুফ-যাকাতকে প্রাতিষ্ঠানিক করা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যকে অধিকার হিসেবে সুরক্ষা দেওয়া।

শেষে আবারও প্রশ্নটি উচ্চারণ করি—সুদ না থাকলে পৃথিবী কেমন হতো?
আমার উত্তর—পৃথিবী নিখুঁত স্বর্গ নয়; কিন্তু মানুষের জন্য মানবিক হতো। মানুষ রাতে ঘুমোতে পারত একটু নিশ্চিন্তে—“কাল আমার সন্তান না খেয়ে থাকবে কি না”—এই প্রশ্নে বুকের ভেতরটা ততটা কাঁপত না। ব্যবসায়ী ও ক্রেতা টেবিলের দুই প্রান্তে বসে ‘প্রতিপক্ষ’ হতো না; ‘সহযোগী’ হতো। ব্যাংকার ও উদ্যোক্তা লাভ-ক্ষতি ভাগ করে একসাথে ঝুঁকি নিত, একসাথে পুরস্কার পেত। শাসক মুদ্রার কল টেনে ‘অদৃশ্য কর’ বসাত না; জনগণের কাছে জবাব দিত। মসজিদের মিনার আকাশ ছোঁত না; কিন্তু দরজার বাইরে ক্ষুধার্তের পেট ভরত। উন্নয়নের ব্যানারে চওড়া রাস্তা থাকত, কিন্তু তার নিচে চাপা পড়ত না মানুষের কান্না। এই পৃথিবী—অতি উচ্চারণে বলছি না—সম্ভব। এটা কল্পকথা নয়; এটা নীতির প্রশ্ন, নকশার প্রশ্ন, সাহসের প্রশ্ন।

ইতিহাস সাক্ষী—ফিরআউন বেঁচে থাকে না, পিরামিড থাকে। আজকের মানি-এম্পায়ারও অমর নয়। আল্লাহর নিয়ম এই—“তুমি দাও, আমি বাড়াই; তুমি কু-উপার্জনে ফুলাও, আমি মুছে দিই।” আমরা কোন নিয়মে বিশ্বাস রাখব, কোন পথে হাঁটব—সিদ্ধান্ত আজই নিতে হবে। কারণ, সুদের বাসা যতদিন দেয়ালে থাকবে, ততদিন বিষ ছড়িয়ে যাবে; আর বাসা ভাঙার সাহস না থাকলে, সাপ মারার ভান করে লাভ নেই।

আমি আশাবাদী। মানুষ যখন সত্যিকারের প্রশ্ন করতে শুরু করে—“আমার টাকাটা গেল কই?”, “এই ইনফ্লেশন কে খায়?”, “আমি যে দান করি তার ঠিকানা কোথায়?”—তখনই পরিবর্তনের প্রথম ইট বসে যায়। আমরা সেই ইটটা বসাতে পারি—নিজের ঘরে, নিজের ব্যবসায়, নিজের মসজিদে, নিজের রাষ্ট্রে। ছোট থেকে বড়—বৃত্তটা বড় হবে। সুদহীন পৃথিবী একদিন হয়তো পুরোপুরি বাস্তবায়িত না-ও হতে পারে; কিন্তু আমরা যতটা পারি ততটা মানুষ হয়ে উঠতে পারি। আর সেই মানুষই অর্থনীতির আসল মুদ্রা—যার মান কখনো অবমূল্যায়িত হয় না।

লেখকঃ গবেষক ও বিশ্লেষক

মাতৃভূমির খবর

Link copied!