শুক্রবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া দুর্লভ টাকার স্মৃতি

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি

শহিদুল ইসলাম খোকন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২৫, ০৪:২১ পিএম

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশের প্রতিটি কাগুজে টাকা ছিল কেবল অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক। আজ বহু টাকাই প্রচলন থেকে হারিয়ে গেছে, তবে সেগুলো রেখে গেছে এক অমর স্মৃতি, যা এখনও মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
কাগুজে টাকার প্রতীকী শক্তি:
বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনতার পর যে সব টাকার নোট ছাপিয়েছিল, সেগুলোর নকশায় প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের সংগ্রামী ইতিহাস ও গৌরবময় ঐতিহ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—
২ টাকার নোটে দোয়েল : বাংলাদেশের জাতীয় পাখি, যা আমাদের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
৫ টাকার নোটে কৃষক ও নৌকা : কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ও নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
১০ টাকার নোটে শহীদ মিনার : ভাষা আন্দোলনের চিরন্তন স্মারক।
২০ টাকার নোটে সুন্দরবনের হরিণ : জীববৈচিত্র্যের অমূল্য সম্পদ।
৫০ ও ১০০ টাকার নোটে ষাট গম্বুজ মসজিদ ও পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার : স্থাপত্যের গৌরবময় নিদর্শন।
৫০০ টাকার নোটে জাতীয় সংসদ ভবন : গণতন্ত্র ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ, নদী, কৃষক, কারিগর, গবাদি পশু ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নোটে জায়গা পেয়েছিল, যা এক অর্থে ছিল চলমান শিল্পকর্ম।

কেন হারিয়ে গেল এই নোটগুলো?

প্রযুক্তির উন্নয়ন, জাল নোট প্রতিরোধ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ এবং অর্থনীতির পরিবর্তনের কারণে ধাপে ধাপে প্রত্যাহার করা হয়েছে বহু নোট। পুরনো ১, ২, ৫, ১০ ও ২০ টাকার নোট এখন আর প্রচলনে নেই। একসময় বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এসব টাকা এখন কেবল সংগ্রাহকের অ্যালবাম বা জাদুঘরের তাকেই সীমাবদ্ধ।

স্মৃতির অমূল্য সম্পদ:

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে বেশিরভাগ পুরনো নোট ধাপে ধাপে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সংগ্রাহক মহলে এসব টাকার দাম তার আসল মূল্যের চেয়ে শতগুণ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি ২ টাকার দোয়েল ছাপানো নোট এখন ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আর কিছু দুর্লভ নোট নিলামে পৌঁছে যাচ্ছে হাজার টাকার ওপরে।

ইতিহাস রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ:

বিশ্বের অনেক দেশে পুরনো নোট ও মুদ্রা নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে স্থায়ী প্রদর্শনী রয়েছে। বাংলাদেশেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবনে ( মুদ্রা জাদুঘর) স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে দেখা যায় ১৯৭১ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত সব নোট। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বিষয়ে আরও প্রচারণা প্রয়োজন যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে— প্রতিটি নোট শুধু অর্থ নয়, ইতিহাসের দলিল।

সাধারণ মানুষের আবেগ:

আজও বয়স্ক মানুষরা স্মৃতিচারণ করেন—কিভাবে একসময় হাতখরচের টাকায় হাতে থাকত একটি ২ টাকার দোয়েল নোট কিংবা ১০ টাকার শহীদ মিনারের ছবি। সেই নোটগুলো আজ আর নেই, কিন্তু রয়েছে তাদের স্মৃতিতে। অনেকেই মনে করেন, এসব নোট হারিয়ে যাওয়া মানে শৈশব, সংগ্রাম ও দেশপ্রেমের সঙ্গে জড়িত এক টুকরো ইতিহাস হারিয়ে যাওয়া।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব:

দক্ষিণ এশিয়ার নোট সংগ্রাহক মহলে বাংলাদেশের পুরনো টাকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিদেশি নুমিসম্যাটিক (নোট ও মুদ্রা সংগ্রাহক) সংগঠনগুলোতে বাংলাদেশের পুরনো টাকা বিশেষ মর্যাদা পায়। এভাবে আমাদের নোট বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করছে।

শেষকথা:

বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া দুর্লভ টাকার নোট কেবল অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম ছিল না; এগুলো জাতির পরিচয়, সংগ্রাম, গৌরব ও সংস্কৃতির অমূল্য প্রতিচ্ছবি। আজ যখন বিশ্ব এগোচ্ছে ডিজিটাল লেনদেনের দিকে, তখন এই হারিয়ে যাওয়া নোটগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি। এগুলো শুধু টাকার কাগজ নয়—ইতিহাসের দলিল, জাতীয় স্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গর্বের ঐতিহ্য।

মাতৃভূমির খবর

Link copied!