মোহাম্মদ আনিসুর রহমান সোহাগ
প্রকাশিত: আগস্ট ২৩, ২০২৫, ০৪:০৫ পিএম
ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ইনফোগ্রাফিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এর দাবি চমকপ্রদ এবং ভয়ঙ্কর—অধিকাংশ মুসলিম তরুণ-তরুণী নাকি জিনায় লিপ্ত, মাদক গ্রহণ করছে, এমনকি অ্যালকোহল পানও করছে। সাধারণত Family and Youth Institute নামের একটি সংগঠনের তৈরি এই ইনফোগ্রাফিক হঠাৎ হঠাৎ ভাইরাল হয়ে যায়, বিশেষ করে মুসলিম কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
অনেকে হয়তো সতর্ক করার উদ্দেশ্যে এটি শেয়ার করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই পরিসংখ্যান আসলেই কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
কী বলা হয়েছে ইনফোগ্রাফিকে
ইনফোগ্রাফিকটিতে চারটি বড় দাবি করা হয়—
প্রথম দেখায় পরিসংখ্যানগুলো এতটাই ভয়াবহ যে মনে হতে পারে মুসলিম সমাজ ভয়ঙ্কর সংকটে আছে। অনেকেই তখন বলেন—“দেখুন, আমাদের যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আমাদের বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
কিন্তু একবার ভেবে দেখা উচিত—আসলেই কি এ সংখ্যা সঠিক?
সমস্যার মূল কোথায়
এমন তথ্য ভাইরাল হওয়ার দুটি বড় সমস্যা রয়েছে।
প্রথমত, এটি মুসলিমদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। মনে হয়, আমাদের সমাজের তরুণ প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে, আর কোনো আশা নেই। এ ধরনের হতাশা ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, পরিসংখ্যানগুলো প্রকৃত অর্থে সঠিক নয়। বিভিন্ন দেশের গবেষণা প্রমাণ করে—মুসলিমরা নন-মুসলিমদের তুলনায় মাদক, জুয়া কিংবা জিনার মতো আচরণে অনেক কম জড়িত। খ্রিস্টান, নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সঙ্গে তুলনা করলে মুসলমানদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো।
তাহলে এ ধরনের ইনফোগ্রাফিকের উদ্দেশ্য কী?
ভুয়া গবেষণার খেলা
এই তথাকথিত পরিসংখ্যানের ভিত্তি দুটি গবেষণা—
প্রথম গবেষণাটি এসেছে ২০০১ সালের একটি ফোন জরিপ থেকে। সেখানে ১০,৪০১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১৩৫ জন জানিয়েছিল যে তারা মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ মোট ডেটার মাত্র ১.৩%। এই ক্ষুদ্র সংখ্যা কতটা প্রতিনিধিত্বশীল, তা নিয়েই বড় প্রশ্ন আছে। “মুসলিম পরিবারে বেড়ে ওঠা” বলতে ঠিক কী বোঝানো হচ্ছে সেটিও অস্পষ্ট। তাদের ধর্মীয় শিক্ষা বা প্র্যাকটিস সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।
দ্বিতীয় গবেষণার অবস্থা আরও খারাপ। গবেষক সোফিয়া আলী ফয়সাল অংশগ্রহণকারীদের সংগ্রহ করেছেন নিজের বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত এবং ফেসবুক গ্রুপ থেকে। অনেক গ্রুপের নামই ছিল “Fitna Feminists”—যারা উগ্র নারীবাদী এবং ইসলামবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত।
এমন মানুষদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে যদি দেখা যায় ৬৭% জিনায় লিপ্ত, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু এটাকে পুরো মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব হিসেবে দেখানো নিছক প্রতারণা।
গবেষণার ভেতরের প্রতারণা
সোফিয়া আলী ফয়সালের থিসিসে অংশগ্রহণকারীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল—তাদের যৌন অভিজ্ঞতা আছে কি না, বিবাহের আগে তারা যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে কি না।
এই তথ্য থেকেই চার্ট বানিয়ে বলা হলো—৬৭% মুসলিম তরুণ-তরুণী জিনা করছে।
এমনকি জরিপের পদ্ধতিও ছিল হাস্যকর। অংশগ্রহণকারী সংগ্রহে ব্যবহার করা হয়েছে snowballing technique—অর্থাৎ গবেষকের পরিচিতরা অংশ নিয়েছে, তারাও আবার নিজেদের পরিচিতদের যুক্ত করেছে। কোনো র্যান্ডম স্যাম্পলিং নেই, কোনো জাতীয়ভাবে প্রতিনিধিত্বশীল নমুনা নেই।
সব ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছে অনলাইনে, মূলত ফেসবুকের বিজ্ঞাপন দিয়ে। ফলে এটি টুইটার বা টেলিগ্রামের সাধারণ ভোটের চেয়েও কম মানসম্পন্ন।
উদ্দেশ্য কী?
এমন ভুয়া পরিসংখ্যান ছড়ানোর আসল উদ্দেশ্য ভিন্ন—
এভাবেই কাজ করে Family and Youth Institute–এর মতো সংগঠন। তারা বলবে—“সমস্যা ভয়াবহ, আমাদের বিশেষজ্ঞ কাউন্সিলর দরকার।” আর সমাধান হিসেবে নিজেদের সেবা বিক্রি করবে।
এটা একধরনের ব্যবসা মডেল—সমস্যা বানানো, সমাধান বিক্রি করা।
মুসলিম সমাজের বাস্তব চিত্র
বাস্তবে আজকের তরুণ প্রজন্মের ভিন্ন সমস্যা আছে। অনেক মুসলিম তরুণ-তরুণী বিয়েতে প্রবল আগ্রহী হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাধার কারণে তা করতে পারছে না। পশ্চিমা সমাজে যেমন একসময় কলেজ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই প্রিম্যারিটাল সেক্সে লিপ্ত ছিল, বর্তমানে তা সত্য নয়। বরং এখন incel সমস্যা বাড়ছে—যেখানে অনেক তরুণ সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়ে একাকীত্বে ভুগছে।
অর্থাৎ মুসলিম তরুণদের মধ্যে সমস্যা থাকলেও তা এই ভুয়া পরিসংখ্যানের মতো ভয়াবহ নয়।
শেষ কথা
এমন গবেষণা ও ইনফোগ্রাফিক আসলে একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডার অংশ। উদ্দেশ্য হলো—মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবমূর্তি নষ্ট করা, ইমামদের ক্ষমতাহীন করা, এবং মুসলিম সমাজে পশ্চিমা উদারপন্থী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া।
তাই মুসলিমদের উচিত—ভাইরাল হওয়া চার্ট বা ইনফোগ্রাফিক দেখে আতঙ্কিত না হয়ে, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা করা। সঠিক তথ্য যাচাই করা।
কারণ ভুয়া পরিসংখ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে কখনোই কোনো সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না।
মাতৃভূমির খবর