মনিকা সোহাগ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫, ০৯:৫৬ এএম
ছবি: মাতৃভূমির খবর ডিজিটাল
আমরা প্রায়ই ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করি, আলোচনা করি, তর্ক করি। এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়, কারণ ঈমানই সব কিছুর ভিত্তি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ঈমানের সঙ্গে যে চরিত্রের সম্পর্ক, সেটি নিয়ে আমরা কতটা ভাবি?
কুরআন খুলে দেখুন, যেখানে ঈমান বা ইবাদতের কথা বলা হয়েছে, সেখানেই চরিত্র গঠনের কথা এসেছে। মহান আল্লাহ তাআলা প্রতিটি নির্দেশের পেছনে আমাদের আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্য রেখেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “আমাকে পাঠানো হয়েছে চরিত্রকে পরিপূর্ণ করার জন্য।” তাই চরিত্রের বিষয়টিই আসলে আমাদের ঈমানের প্রাণ।
আমরা শুরু করছি সূরা হুজুরাত থেকে। এ সূরার ছয় নম্বর আয়াতেই একটি অসাধারণ শিক্ষা রয়েছে:
“হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক (অবিশ্বস্ত) ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করে নাও। যেন অজান্তেই তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতি না করে বসো, আর পরে তোমরা অনুতপ্ত হও।” (সূরা হুজুরাত: ৬)
এ আয়াতের শিক্ষা সহজ হলেও অত্যন্ত গভীর। একটি ভুল সংবাদ, যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রচার করা—একটি পরিবার, একটি সমাজ বা এমনকি একটি পুরো জাতিকেও ভেঙে দিতে পারে। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি সবচেয়ে বেশি ঘটে।
ধরা যাক, আপনি দেখলেন একজন বিবাহিত ভাই একটি অচেনা নারীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন। চোখে যা দেখলেন, সেটি তো সত্য। কিন্তু আসল সত্য জানার জন্য প্রয়োজন যাচাই। হয়তো তিনি উবার চালক, হয়তো সেটি তাঁর আত্মীয়, কিংবা প্রতিবেশীকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। যাচাই ছাড়া যদি কাউকে ব্যভিচারী বলে বসেন, তবে সেটি ভয়াবহ অপবাদ হবে।
আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে আমাদের দুই রকম ক্বিরআত শিখিয়েছেন—
“ফাতাবাইয়ানু” অর্থাৎ, সত্য-মিথ্যা যাচাই করো।
“ফাতাসাব্বাতু” অর্থাৎ, পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হও।
অর্থাৎ, চোখে দেখা একটি তথ্যও চূড়ান্ত সত্য নয়—পেছনের প্রেক্ষাপট যাচাই করা জরুরি।
রাসূল ﷺ এক সাহাবিকে পাঠিয়েছিলেন সদ্য মুসলিম হওয়া একটি গোত্র থেকে যাকাত সংগ্রহ করতে। তাঁর পূর্ব-ইসলামী শত্রুতার কারণে তিনি ভয় পেয়ে ফিরে আসেন এবং মিথ্যা খবর দেন যে, গোত্রটি যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে। সাহাবারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। ঠিক তখনই এ আয়াত অবতীর্ণ হয়—“যাচাই করো, নিশ্চিত হও।”
এটি আমাদের শিখিয়ে দেয়—গুজব বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া ইসলামী নীতি নয়।
অনেকে মনে করেন, শুধু অবিশ্বস্ত মানুষের খবর যাচাই করতে হবে। কিন্তু সত্য হলো—যেকোনো খবরই যাচাই করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, হযরত আবু বকর (রা.) একবার একটি ঘটনা নিয়ে নবী করিম ﷺ এর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি সত্যবাদী হলেও নবী ﷺ অপর পক্ষকেও ডেকে সত্যতা যাচাই করেন।
এখান থেকে শিক্ষা হলো—ব্যক্তি যতই বিশ্বস্ত হোক না কেন, বিষয়টি গুরুতর হলে যাচাই প্রয়োজন।
আজ আমরা প্রায়ই দেখি—কোনো বক্তার বক্তব্যের আংশিক ভিডিও কেটে ভাইরাল করে দেওয়া হয়। এরপর মানুষ যাচাই না করে গালাগালি করে, কাউকে “বিদআতী”, “কাফের” বা “ভ্রষ্ট” বলে বসে। অথচ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন:
“কোনো মুসলিমকে শুধু অনুমান বা সন্দেহের ভিত্তিতে কাফের বলা যাবে না। সত্য পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা না হলে এবং সন্দেহ দূর না হলে তার ঈমান অটুট থাকবে।”
এটি এক বিরাট শিক্ষা। আমাদের দায়িত্ব হলো, ভাইকে রক্ষা করা—তার চরিত্র ধ্বংস করা নয়।
সূরা হুজুরাত আমাদের প্রথম পাঠ দেয়—সংবাদ যাচাই করো, আবেগের বশবর্তী হয়ো না। চরিত্রবান মুসলিম সেই, যে নিজের জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করে, কারও মানহানি করে না, সত্য যাচাই ছাড়া কিছু প্রচার করে না।
আমরা যদি সত্যিই ইসলামকে ভালোবাসি, তবে আমাদের উচিত হবে এমন চরিত্র গড়ে তোলা, যেখানে অন্যের সম্মান রক্ষা করা হবে নিজের সম্মান রক্ষার মতোই জরুরি।
মাতৃভূমির খবর