এম রাশেদুল হক
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ০৩:২০ পিএম
বাংলাদেশের খ্যাতনামা পরমাণুবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং বহুমুখী চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ শমশের আলী আর নেই। ২ আগস্ট ২০২৫, রাতের শেষ প্রহরে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার প্রয়াণে দেশের বিজ্ঞানচর্চা, শিক্ষা এবং বৌদ্ধিক জগতে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো।
১৯৩৭ সালের নভেম্বরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জন্ম নেওয়া এই মনীষীর শৈশব কেটেছে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও ভারতের রানাঘাটে। শমশের আলী শৈশব থেকেই মেধার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে আন্তর্জাতিক বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। কিংবদন্তি বিজ্ঞানী লর্ড ব্রায়ান ফ্লাওয়ার্স ও স্যার স্যাম অ্যাডওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে গবেষণা সম্পন্ন করে তিনি ১৯৬৫ সালে তাত্ত্বিক পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি অর্জন করেন।
দেশে ফিরে তিনি পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হন এবং টানা দুই দশক নেতৃত্ব দেন। তার গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে সমাদৃত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারি প্রফেসর ও স্বর্ণপদকে ভূষিত করে।
শিক্ষক হিসেবে ড. শমশের আলীর সুনাম ছিল জটিল বৈজ্ঞানিক ধারণা সহজ ভাষায় উপস্থাপনার জন্য। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে তিনি দেশে দূরশিক্ষা পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করেন। এ ছাড়াও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ধারায় এগিয়ে নেন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতি হিসেবে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অঙ্গনে দেশের মর্যাদা উঁচুতে তুলেছিলেন।
তার বিশেষ কৃতিত্ব ছিল বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও, এমনকি বিবিসিতেও সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিক ধারণা তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনার চেষ্টা করেছেন। তার নেতৃত্বে প্রকাশিত ‘পবিত্র কোরআনে বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত’ এবং ‘Muslim Contribution to Science and Technology’ গ্রন্থ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে।
ড. শমশের আলী ছিলেন এমন এক আলোকবর্তিকা, যিনি এক হাতে বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়েছেন, অন্য হাতে শিক্ষা প্রশাসন ও জ্ঞান-সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন—শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, যা বয়স বা অবস্থান নির্বিশেষে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তার প্রয়াণে বাংলাদেশ হারাল এক অনন্য দিশারী, যিনি ছিলেন বিজ্ঞান, শিক্ষা ও চিন্তার মহিরুহ।
লেখকঃ গবেষক ও কলাম লেখক
মাতৃভূমির খবর