শহিদুল ইসলাম খোকন
প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ০১:১৭ পিএম
শহীদ শিশুদের ছবি গুলো সংগৃহীত
“তাদের চোখে ছিল প্রশ্ন, মুখে ছিল নীরবতা। কিন্তু জবাব ছিল না রাষ্ট্রের কাছে—আজও নেই।”
এই শিশুদের চোখের দিকে তাকানোর মতো সাহস আছে আপনাদের? যাদের বয়স ছিল কেবল খেলা করার, যাদের হাতে বই থাকার কথা ছিল, তাদের মুখে আজ আর কোনো শব্দ নেই।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনে, রাষ্ট্রীয় দমননীতির নির্মম বুলেটে ঝরে পড়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতীক — কোমলমতি শিশু-কিশোরেরা।
তারা অপরাধী ছিল না। তারা রাজনীতিবিদ ছিল না, ষড়যন্ত্রকারীও নয়। তারা ছিল আমাদের সন্তান, আমাদের ভাই-বোন, আমাদের ভবিষ্যৎ। অথচ এই অবুঝ শিশুগুলোকেই রাষ্ট্রের আইনরক্ষক বাহিনীর নির্মমতা থেকে রক্ষা করতে পারেনি এই সমাজ, এই মানবতা, এই তথাকথিত সভ্যতা। "শহীদদের তালিকা: শিশুর মুখে গুলি, রাষ্ট্রের মুখে নীরবতা''
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক গণআন্দোলনে, স্বৈরাচারী সরকারের নিপীড়ন এবং পুলিশের বুলেটে প্রাণ হারানো সেই কোমলমতি জাতীয় বীর শহীদ শিশু-কিশোরদের: তাদের কথা কি একটিবারের জন্য কেউ মনে রেখেছেন?
১. শহীদ আহাদ — বয়স: ৪ বছর
বাবার কোলে ছিল। পুলিশের গুলিটি তার চোখ ভেদ করে মাথায় আটকে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ।
২. শহীদ রিয়া — বয়স: ৬ বছর
ছাদে খেলতে খেলতে গুলির শব্দে চমকে ওঠে। একটি বুলেট তার মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। মারা যায় মায়ের কোলে।
৩. শহীদ হোসাইন — বয়স: ১০ বছর
আন্দোলন দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
৪. শহীদ সামির — বয়স: ১১ বছর
জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়।
৫. শহীদ মোবারক — বয়স: ১৩ বছর
রাস্তায় মিছিল দেখছিল। পুলিশের লক্ষ্যহীন গুলিতে প্রাণ হারায়।
৬. শহীদ তাহমিদ — বয়স: ১৪ বছর
পুলিশের পিটুনিতে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়। পরে গুলি করে হত্যা করা হয়। শরীরে ছিল অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
৭. শহীদ ইফাত — বয়স: ১৬ বছর
আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
৮. শহীদ নাঈমা — বয়স: ১৬ বছর
নিজ বাসার বারান্দা থেকে আন্দোলন দেখছিল। একটি গুলি এসে মাথায় বিদ্ধ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
"জুলাইয়ের বুকে রক্ত, আগস্টে ‘অবকাশ'’: নেতৃত্বের নামান্তরে লজ্জা,
যারা এতদিন ধরে দাবি করে এসেছেন, "জুলাই আমাদের নতুন স্বাধীনতার সূচনা", তারা আজ কোথায়?
যখন শহীদ পরিবারগুলো বিচার ও জুলাই সনদ এর জন্য পথে নেমেছে, তখন আন্দোলনের অনেক মুখ ৫ আগস্ট ২০২৫ গেলেন অবকাশ যাপনের নামে কক্সবাজারের সৈকতে, তাও আবার হাজারো শহীদদের রক্তে এবং হাজারো আহত ২০২৪ জুলাই-আগষ্ট এর আহত যোদ্ধা ও বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার এবং সাধারণ নাগরিকের প্রাণের চাওয়া সেই জুলাই সনদের দিনটিই তাদের বেছে নিতে হলো অবকাশযাপনের জন্য? এ প্রশ্ন রেখে গেলাম সুশীল সমাজ রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন, রাজনৈতিক দল এবং সমগ্র জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অগ্রভাগে থেকে যারা এতদিন নেতৃত্ব দিয়ে এসেছিলেন তারাই কেন আজ জুলাইকে কুলুষিত করলেন?,
এই দায় কেউ এড়াতে পারে না।
এই লজ্জা কোনো মুখোশ দিয়ে ঢাকা যায় না।
"শহীদ শিশুদের আত্মা জিজ্ঞেস করে—তাদের মৃত্যুর দায় কার?''
এই পরিবারগুলো কি কখনো বিচার পাবে?
তাদের প্রশ্ন—
আমাদের সন্তানদের চোখ দিয়ে কেন গুলি ঢুকেছিল?
তারা কেন এতো তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো?
যারা নেতৃত্বের দাবিদার, তারা কোথায় ছিলেন মৃত্যুর সময়?
এ প্রশ্ন শুধু শহীদ পরিবারদের নয় — পুরো জাতির। এবং এ প্রশ্নের উত্তর আজও রাষ্ট্রের কাছে অনুপস্থিত।
"এ দায় এড়ানো যাবে না''
এই শহীদ শিশুরা আমাদের বিবেকের আয়নায় প্রতিদিন ভেসে ওঠে।
তাদের প্রশ্ন যদি আপনার হৃদয়ে ঢেউ তোলে না, তবে আপনি মানুষ নন — আপনি একটি ভঙ্গুর ব্যবস্থার নিঃস্ব প্রতিনিধি।
তারা ক্ষমা করবে না আমাদের — এই রাষ্ট্রকে, এই সরকারকে, এই নেতাদের, এই সমাজকে।
তাদের রক্তে লেখা ইতিহাস কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
"শেষ শব্দ নয়, শুরু হোক জবাবদিহির''
আজ আমি মাথা নত করি এই শহীদ শিশুদের স্মরণে।
আমি কৃতজ্ঞ, তারা তাদের প্রাণ দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে:
মানবতার মৃত্যু হলে রাষ্ট্র টিকে থাকে না।
আমি শ্রদ্ধা জানাই সেই সাহসী পরিবারগুলোর প্রতি, যারা সন্তান হারিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় পাননি।
বাংলাদেশ যতদিন সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখবে, ততদিন এই কোমলমতি শহীদদের নাম থাকবে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে খোদাই করে লেখা থাকবে।
মাতৃভূমির খবর