প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৫, ১১:২২ পিএম
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী স্বৈরাচারের পতনের এক বছর পূর্তিতে গত ৫ আগস্ট সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক বর্ণাঢ্য সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ঘোষিত এ দলিলকে অনেকে নতুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপরেখা হিসেবে দেখছেন। বৃষ্টিভেজা বিকেলে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা এবং ভবিষ্যতের সংস্কার কর্মসূচি একটি নতুন ধাপে প্রবেশ করল।
তবে ঘোষণাপত্র প্রকাশের পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে—এটি বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো কী হবে এবং কতটুকু বাধ্যবাধকতা তৈরি করবে?
ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ঘোষণাপত্র ঘোষণার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে ভিন্ন হয়ে ওঠে। বিএনপি এ ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ একাধিক দল প্রকাশ করেছে অসন্তুষ্টি। তাদের অভিযোগ, ঘোষণাপত্রে ইসলামপন্থী দলের আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক ভূমিকা কিংবা অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—যেমন ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর গণহত্যা বা পিলখানা ট্র্যাজেডি—উপেক্ষা করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের আমিরের মতে, সাংবিধানিক সংস্কারকে পরবর্তী সংসদের হাতে ন্যস্ত করা গণ-অভ্যুত্থানের মর্যাদা খর্ব করেছে। অন্যদিকে বিএনপি খুশি হয়েছে ঘোষণাপত্রে থাকা প্রতিশ্রুতিগুলোকে নির্বাচিত সংসদের হাতে ন্যস্ত করার ধারায়।
এ অবস্থায় স্পষ্ট যে, ঘোষণাপত্র সবার মতামতের পূর্ণ প্রতিফলন নয়। ফলে আসন্ন জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে আরও বড় রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা দিতে পারে।
বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পথ
এখন প্রশ্ন—কোন আইনি প্রক্রিয়ায় ঘোষণাপত্র ও সনদ বাস্তবায়ন করা সম্ভব? এখানে কয়েকটি সম্ভাবনা আলোচনায় এসেছে:
১. সংবিধান সংশোধন: বিদ্যমান সংবিধান বহাল রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হলে পরবর্তী জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেখানে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা রাজনৈতিক বাস্তবতায় কঠিন হতে পারে।
২. গণপরিষদ বা গণভোট: এনসিপি সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য গণপরিষদ গঠনের দাবি তুলেছে। অন্যদিকে গণভোটও একটি সম্ভাব্য পথ। জনগণ সরাসরি মতামত দিলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় পরিণত হবে। তবে অতীতে বাংলাদেশের গণভোট নিয়ে বিতর্ক থাকার কারণে এ প্রক্রিয়ায় আস্থার সংকটও থেকে যেতে পারে।
৩. অধ্যাদেশ জারি: অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার বা বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করতে পারে, যা তাৎক্ষণিকভাবে সনদের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তবে এর পরবর্তী সংসদে অনুমোদন পাওয়া অনিবার্য।
৪. সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ: আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরামর্শ নিয়ে সাংবিধানিক আদেশ জারি করা সবচেয়ে কার্যকর ও টেকসই হতে পারে। এটি পরবর্তী সংসদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আইনি ভিত্তি শক্তিশালী করতে পারে।
প্রশাসনিক বাস্তবায়নের সুযোগ
সব সুপারিশ সাংবিধানিক নয়। অনেক বিষয় প্রশাসনিক বা নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও বাস্তবায়ন সম্ভব। যেমন—জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি সমন্বিত ওয়েব পোর্টাল তৈরির উদ্যোগ এখনই নেওয়া যেতে পারে। আবার দুর্নীতি দমন, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, কিছু মানবাধিকার সম্পর্কিত পদক্ষেপ বা শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার অধ্যাদেশ বা নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য। এর ফলে জনগণের কাছে সংস্কারের দৃশ্যমানতা দ্রুত তৈরি হবে।
ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবি
এ মুহূর্তে আরেকটি বড় দাবি হলো—জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যারা হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও দমনপীড়নে যুক্ত ছিল তাদের বিচার দ্রুত শুরু করা। অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগেই এ বিচার দৃশ্যমান করতে চায়। সরকার জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং ডিসেম্বরের আগেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ না করতে হলে সময়মতো সব প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।
পরিশেষে
স্পষ্টতই, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন শুধু রাজনৈতিক দলিল নয়; এটি মুক্তি, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা। কিন্তু এ রূপরেখা সফল হবে কিনা তা নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে প্রশাসনিক পর্যায়ে অবিলম্বে কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে, আর সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে সর্বদলীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ যে আত্মত্যাগ ও প্রত্যাশা নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে, তার প্রকৃত সম্মান তখনই রক্ষা পাবে, যখন ঘোষণাপত্র ও জাতীয় সনদ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবে মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
— জীবন সালেহিন,
গবেষক ও সামাজিক চিন্তক