প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
তরুণ প্রজন্ম একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের কাঁধে ভর করেই রাষ্ট্র এগিয়ে যায়, সমাজ নতুন দিশা খুঁজে পায়। তরুণদের স্বপ্ন, পরিশ্রম, উদ্ভাবনী শক্তি আর মানবিকতার আলোয় ভবিষ্যৎ হয় আলোকিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো—আজকের তরুণরা কি সত্যিই তাদের সেই স্বপ্নপথে হাঁটছে? নাকি তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার বিষাক্ত রাজনীতির অন্ধকারে?
আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দিনে ঘন্টা নয়, অনেকের জন্য তা হয়ে দাঁড়িয়েছে দিন-রাতের সঙ্গী। পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর, বিনোদন, এমনকি রাজনৈতিক চেতনা গঠনের ক্ষেত্রও হয়ে উঠেছে এই প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ইতিবাচক সম্ভাবনার চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই এখন বেশি প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে।
একসময় রাজনীতি মানে ছিল মূল্যবোধ, আদর্শ, জাতীয় উন্নয়ন, নেতৃত্ব আর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার রাজনীতি তার সম্পূর্ণ উল্টো রূপ ধারণ করেছে। এখানে চলছে অন্ধ সমর্থন, ঘৃণার ভাষণ, গুজব, ট্রল আর চরিত্রহননের প্রতিযোগিতা। তরুণরা যখন প্রতিদিন এসব দেখছে ও শিখছে, তখন তাদের মানসিকতা কেমন হয়ে উঠছে—এ প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক কিংবা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম আসলে ব্যবহারকারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে উত্তেজনাকর ও বিতর্কিত কনটেন্টকে সামনে আনে। ফলে যেসব পোস্টে গালাগাল, বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা কিংবা রাজনৈতিক শত্রুতা থাকে, সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তরুণরা প্রতিনিয়ত যখন এসব কনটেন্ট দেখে, তখন তাদের মনে গড়ে ওঠে পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব। তারা ভেবে নেয় রাজনীতি মানেই গালি, অপমান আর বিদ্বেষ।
আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, অনেক তরুণ নিজের অজান্তেই হয়ে উঠছে ‘ডিজিটাল রাজনৈতিক সৈনিক’। তারা হয়তো জানেই না কোন খবর আসল আর কোনটি ভুয়া। তবুও তারা অন্ধভাবে শেয়ার করছে, মন্তব্য করছে, গালাগাল করছে। একসময় এভাবেই তারা হয়ে উঠছে বিভক্ত সমাজের বাহক, যেখানে যুক্তি আর আলোচনার কোনো জায়গা নেই।
তরুণদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তাদের স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা আর পরিবর্তন আনার সাহস। কিন্তু যখন তারা দিন-রাত শুধু গালাগালপূর্ণ রাজনৈতিক পোস্টে ডুবে থাকে, তখন সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। তারা আর উদ্ভাবন নিয়ে ভাবে না, নতুন চিন্তাধারায় মনোযোগী হয় না, বরং বিভাজনের রাজনীতিতে মেতে ওঠে। এর ফলে একটি জাতির ভবিষ্যৎই অন্ধকারে ঢেকে যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কি এই চিত্র দেখতে চাই? নিশ্চয়ই না। তাই এখনই প্রয়োজন পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের সমন্বিত উদ্যোগ। পরিবারকে সন্তানদের শেখাতে হবে কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট যাচাই করতে হয়, কীভাবে ভুয়া খবর চিনতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তরুণদের মধ্যে যুক্তিবাদী চিন্তাশক্তি ও সহনশীলতার চর্চা বাড়াতে হবে। আর রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া খবর ও ঘৃণার রাজনীতি ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ।
তরুণদেরও শিখতে হবে রাজনীতির প্রকৃত মানে। রাজনীতি মানে গালি নয়, বরং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। রাজনীতি মানে বিভক্তি নয়, বরং উন্নয়ন আর ঐক্যের পথে এগিয়ে যাওয়া। যদি তরুণরা এটি বুঝতে শেখে, তবে তারাই হবে আগামী দিনের আলোর মশাল।
বিষাক্ত রাজনীতির ফাঁদে যদি তরুণরা বন্দি হয়, তবে আমরা পাবো একটি অস্থির, বিভক্ত ও অশান্ত সমাজ। কিন্তু যদি তরুণরা সঠিক পথে এগোয়, তবে তারাই গড়বে নতুন বাংলাদেশ—যেখানে থাকবে জ্ঞান, সততা, মানবিকতা আর প্রজ্ঞার আলো।
সুতরাং আজই আমাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে—আমরা তরুণদের কী দিচ্ছি? সোশ্যাল মিডিয়ার বিষাক্ত রাজনীতি, নাকি গঠনমূলক চিন্তার মশাল? তরুণদের হাতে যদি আলো তুলে দেওয়া যায়, তবে তারাই হবে এই জাতির সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।