প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ০৫:০৬ এএম
কয়েকটি প্যানেলসহ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট বর্জন এবং অনিয়মের অভিযোগের মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদের ভোটগ্রহণ শেষে গণনা শুরু হয়েছে।
প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে ২১টি হলে শুরু হওয়া ভোটগ্রহণ বড় ধরনের কোনো গোলযোগ ছাড়াই বিকাল ৫টায় শেষ হয়। ভোট গণনা শুরু হয় রাত ১০টার পরে। ভোট গণনা করা হচ্ছে ম্যানুয়ালি। দেখানো হচ্ছে এলইডি স্ক্রিনে।
কয়েকটি হলে ভোটারের দীর্ঘ লাইন থাকায় নির্ধারিত সময়ের পরেও ভোটগ্রহণ করা হয়। সবশেষ রাত সাড়ে ৭টার দিকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলের ভোটগ্রহণ শেষ হয়।
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর হলগুলো থেকে ব্যালট বাক্স কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সিনেট ভবনে নিয়ে আসা হয়। এখান থেকেই গণনা শেষ করে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
ভোট ঘিরে সিনেট ভবন ঘিরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। পুরো ক্যাম্পাসজুড়েই রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের গেইটগুলোতে প্রচুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিজিবি সদস্যদের দেখা গেছে।
সিনেট ভবনে থাকা সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, রাত ১০টার পরে ভোট গণনা হয়। প্রথমে জাতীয় কবি কাজী নজরুল এবং মীর মশাররফ হোসেন হলের ব্যালট বাক্স খুলে ভোট গণনা শুরু হয়। দুটি হল করে প্রথমে হল সংসদের ভোট গণনা হবে, তারপর কেন্দ্রীয় সংসদের ভোট গণণা হবে।
বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আল বেরুনী হলে ২১১ ভোটারের বিপরীতে ১২৫ ভোট, আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলে ৩৪১ ভোটারের বিপরীতে ২১৬, মীর মশাররফ হোসেন হলে ৪৬৪ ভোটারের বিপরীতে ৩১০, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ২৮০ ভোটারের বিপরীতে ১৩৭, শহীদ সালাম-বরকত হলে ২৯৯ ভোটারের বিপরীতে ২২৪, মওলানা ভাসানী হলে ৫১৪ ভোটারের বিপরীতে ৩৮৪, জাহানারা ইমাম হলে ৩৬৭ ভোটারের বিপরীতে ২৪৭, প্রীতিলতা হলে ৩৯৯ ভোটারের বিপরীতে ২৪৬, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৪০৯ ভোটারের বিপরীতে ২৪৯, ১০নং (ছাত্র) হলে ৫৪১ ভোটারের বিপরীতে ৩৮১, শহীদ রফিক-জব্বার হলে ৬৫৬ ভোটারের বিপরীতে ৪৭০, বেগম সুফিয়া কামাল হলে ৪৫৬ ভোটারের বিপরীতে ২৪৬, ১৩ নং (ছাত্রী) হলে ৫৩২ ভোটারের বিপরীতে ২৭৯, ১৫ নং (ছাত্রী) হলে ৫৭১ ভোটারের বিপরীতে ৩৩৮, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৩৫০ ভোটারের বিপরীতে ২৬১, রোকেয়া হলে ৯৫৫ ভোটারের বিপরীতে ৬৮০, ফজিলাতুন্নেছা হলে ৮০৩ ভোটারের বিপরীতে ৪৮৯, বীরপ্রতীক তারামন বিবি হলে ৯৮৪ ভোটারের বিপরীতে ৫৯৫, ২১ নং (ছাত্র) হলে ৭৩৫ ভোটারের বিপরীতে ৫৬৪, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ৯৯১ ভোটারের বিপরীতে ৮১০ এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে ৯৪৭ ভোটারের বিপরীতে ৭৫২টি ভোট পড়েছে।
জানা গেছে, জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট ৮ হাজার ১৬টি ভোট পড়েছে। ৩৩ বছর হয় হওয়া এই নির্বাচনে মোট ভোটার ছিলেন ১১ হাজার ৯১৯ জন। অর্থাৎ মোট ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৬৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ৬৭ জন পোলিং অফিসার (শিক্ষক) এবং ৬৭ জন সহকারী পোলিং অফিসার (কর্মকর্তা) দায়িত্ব পালন করছেন। ভোটগ্রহণ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে গণনা করা হচ্ছে এবং সেখানেই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
এবারের নির্বাচনে ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৭৮ প্রার্থী। নির্বাচনে বামপন্থি, শিবির, ছাত্রদল ও স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের সমর্থিত ৮টি প্যানেল অংশগ্রহণ করে। তবে, শেষ সময়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সব প্রার্থী। এছাড়া আরও তিনটি প্যানেল ও পাঁচ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন।
এছাড়া পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন ৪টি প্যানেলের প্রার্থীরা। প্যানেলগুলো হলো- সম্প্রীতির ঐক্য, সংশপ্তক পর্ষদ, অঙ্গীকার পরিষদ, ছাত্র ফ্রন্ট একাংশের প্যানেল। এই দাবিতে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও একাত্মতা জানিয়েছেন।
এদিন সকাল ৯টায় জাকসু ও হল সংসদের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১টি হলকে কেন্দ্র করা হয়। ২১ কেন্দ্রে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ হাজার ৮৯৭। এর মধ্যে ছাত্র ছয় হাজার ১১৫ এবং ছাত্রী পাঁচ হাজার ৭২৮ জন। ভোটাররা কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ৪০টি ব্যালটে ভোট দেন (টিক চিহ্ন)।
এদিকে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর সকাল থেকেই বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা নানা অসংগতি ও অনিয়মের কথা বলছিলেন। কিন্তু ভোট কারচুপির সরাসরি অভিযোগ কারও ছিল না। তারা কেন্দ্রে ভোটের চেয়ে ব্যালট বেশি যাওয়া, প্রতিপক্ষের আচরণবিধি ভঙ্গ করা, জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন সরবরাহ করা, পোলিং এজেন্টের অনুমতি থাকলেও তাদের প্রবেশে বাধা দেওয়া, ডোপটেস্টের ফলাফল না আসা, নির্বাচনকে ‘ম্যানিপুলেট’ করার নানা অভিযোগ আসছিল।
ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসেন বৈশাখী। এ সময় তার পাশে প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী শেখ সাদি হাসানও ছিলেন। বৈশাখী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভোটকেন্দ্র মনিটর করার জন্য জামায়াত নেতার কোম্পানি ঘিরে টেলিকাস্টসহ ভিডিও ক্যামেরা সাপ্লাই দিয়ে সিসি টিভির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে পুরো ভোটকেন্দ্র শিবিরকে মনিটর করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিজয় ব্যাহত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জামায়াত শিবিরের সঙ্গে এক হয়ে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের রায়ের সত্যিকার প্রতিফলণ ঘটছে না। তাই আমরা নির্বাচন বর্জন করতে বাধ্য হচ্ছি।
এর পর জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানায় ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সমর্থিত ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেল। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুরাদ চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে তারা এই অনাস্থার কথা জানান। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী শরণ এহসান।
পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাচনে প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা ও ছাত্রশিবিরকে ভোট জালিয়াতিতে সহযোগিতার অভিযোগ তুলে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ প্যানেল।
একই অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন ও পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের ‘স্বতন্ত্র অঙ্গীকার পরিষদ’ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আংশিক প্যানেলের প্রার্থীরা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বেশ কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ঘোষণা দিয়েছেন ভোট বর্জনের।
এছাড়া নির্বাচন নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক।
তারা হলেন, গণিত বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক নাহরিন ইসলাম ও অধ্যাপক শামিমা সুলতানা। বিকালে জাকসু নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে নির্বাচন বর্জনের কথা জানান তারা।