মেহেদি হাসান
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১০:৫৮ এএম
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় বৈষম্য হলো শহর ও গ্রামের ব্যবধান। একদিকে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডিজিটাল ক্লাসরুম, প্রাইভেট কোচিং ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের সমাহার; অন্যদিকে গ্রামের স্কুলগুলোতে এখনো টিনের ছাউনি, ভাঙা বেঞ্চ, শিক্ষক সংকট আর ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার জন্য হাহাকার। এই বৈষম্য কেবল শিক্ষার মান কমাচ্ছে না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দারিদ্র্য ও বঞ্চনার চক্রকে আরও দীর্ঘায়িত করছে।
গ্রামের স্কুলগুলোর অবকাঠামো এখনো অনেক জায়গায় অত্যন্ত নাজুক। বর্ষাকালে স্কুলঘরে পানি ঢোকে, মাটির উঠান কাদা হয়ে যায়, টয়লেট ব্যবহার অনুপযোগী থাকে। অধিকাংশ জায়গায় নেই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সংযোগ কিংবা নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। অনেক স্কুলে এখনো পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, ফলে একসঙ্গে কয়েকটি ক্লাস নিতে হয়। এই অবস্থায় ছাত্রছাত্রীরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে না।
শিক্ষকের সংকটও গ্রামীণ শিক্ষার বড় বাধা। নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, আবার যারা আছেন তাদের অনেকেই নিয়মিত ক্লাস নেন না। শহরে ভালো সুযোগ থাকায় মেধাবী শিক্ষকেরা গ্রামে থাকতে চান না। ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয় মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে।
ডিজিটাল শিক্ষার যুগে শহুরে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বিশ্বমানের কনটেন্ট পাচ্ছে, ইউটিউব, অ্যাপস ও ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। অথচ গ্রামের শিশুদের হাতে অনেক সময় স্মার্টফোন থাকে না, থাকলেও নেই ইন্টারনেট। বিদ্যুৎ বিভ্রাট তো নিয়মিত। ফলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর স্বপ্নের সাথে তারা তাল মেলাতে পারছে না।
অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে গ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়ছে। বোর্ড পরীক্ষায় শহরের স্কুলগুলো যেখানে ভালো ফলাফল করছে, গ্রামের অনেক স্কুলে এখনো পাশের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। উচ্চশিক্ষায় ভর্তি প্রতিযোগিতা কিংবা চাকরির বাজারে এই শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই শহুরে সহপাঠীদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এর সমাধান কোথায়? প্রথমত, গ্রামীণ শিক্ষার অবকাঠামোতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ, নিরাপদ টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও আসবাবপত্র নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে দ্রুত। এজন্য গ্রামে চাকরিকে আকর্ষণীয় করার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে—যেমন বাড়তি ভাতা, প্রশিক্ষণ, আবাসন সুবিধা।
তৃতীয়ত, ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তৃতি ঘটাতে হবে গ্রামে। প্রতিটি স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগ ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমূল্যে ট্যাব বা ডিভাইস সরবরাহ করা গেলে তারা বৈশ্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন। স্থানীয় সমাজ ও প্রবাসীরা একত্র হয়ে যদি গ্রামের স্কুলগুলোর পাশে দাঁড়ান, তবে বাস্তবিক পরিবর্তন আসবে। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদণ্ড—কিন্তু সেই মেরুদণ্ড দুর্বল হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনোভাবেই শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে না।
গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ুক—এটা কেবল তাদের ক্ষতি নয়, বরং পুরো জাতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ একটি দেশের উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন সব শিশু সমান সুযোগে শিক্ষা পায়। তাই এখনই সময় গ্রামীণ শিক্ষা অবকাঠামোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার। নইলে শহর-গ্রামের এই বৈষম্য ক্রমেই গভীর হবে, আর প্রান্তিক শিশুদের স্বপ্ন চিরদিনের মতো পিছিয়ে পড়বে।
লেখকঃ এডুকেশন কনসালট্যান্ট ও কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ
মাতৃভূমির খবর