শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইন্দোনেশিয়ায় সিস্টেম রিসেট আন্দোলন তুঙ্গে

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০৯:৫৭ এএম

ইন্দোনেশিয়ায় সিস্টেম রিসেট আন্দোলন তুঙ্গে

এক ঐতিহাসিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জীয় রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া। রাজধানী জাকার্তায় সংসদ ভবনের সামনে ছাত্র-শ্রমিক-মানবাধিকা সংগঠনের হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছে। তাদের মূল দাবি সিস্টেম রিসেট করা। বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছে দুটি রং- গোলাপি ও সবুজ। গত সপ্তাহে পুলিশের গাড়িচাপায় ২১ বছর বয়সি ডেলিভারিম্যান আফফান কুরনিয়াওয়ান নিহত হন। তিনি সবুজ রঙের ডেলিভারি জ্যাকেট পরে ছিলেন। ঘটনাটি দ্রুত ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে। কয়েক দিন আগে আবার দেখা যায়, সংসদ সদস্যদের বিলাসী বাড়ি ভাড়া ও বিদেশ ভ্রমণের ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব উঠেছে। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য আর মুদ্রাস্ফীতির বিপরীতে তীব্র বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছে। তারপর রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। যোগ দেন শ্রমিকরা। ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামেন নারীরা।

বিক্ষোভ দমন করতে নামানো হয়েছে পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী। সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পুলিশ অযথা শক্তি প্রয়োগ করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা সমস্যার মূলে না গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ আখ্যা দিচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও পার্লামেন্টের সামনে জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, জনগণের সমস্যা দুর্নীতি, বৈষম্য ও আইনের রাজনৈতিক ব্যবহার। সংসদের ডেপুটি স্পিকার বৈঠকের আহ্বান করলেও বিক্ষোভকারীরা বলছে, এটা প্রতারণার কৌশল ছাড়া কিছু নয়। দেশটির জাকার্তা শহরের মোড়ে দেখা গেছে সবুজ-গোলাপি রঙে আঁকা বড় বার্তা, ‘সিস্টেম রিসেট করুন।’ বার্তাটি কাঁচা হাতে লেখা হলেও তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কন্ট্রোল রিস্কসের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর আচমাদ সুকারসোনো বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় ধনী- গরিব বৈষম্য এত দ্রুত বেড়েছে যে সমাজ এখন শুকনো ঘাসের মতো দাহ্য হয়ে আছে। এর মধ্যে এমপিদের বিলাসী ভাতার মতো বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলো দেশজুড়ে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার মতে, এই অস্থিরতা প্রাবোও সরকারের জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিক্ষোভে আরেকটি নজির তৈরি হয়েছে। প্রথমবারের মতো এমপি-মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত বাড়িতে হামলা। অর্থমন্ত্রী মুলইয়ানি রিসেট আন্দোলন তুঙ্গে থেকে শুরু করে জনপ্রিয় তারকা-রাজনীতিবিদদের বাড়িতে পর্যন্ত হানা দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। টিভি, গহনা, গাড়ি থেকে শুরু করে এমনকি পোষা প্রাণী পর্যন্ত চুরি গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, জনতা বিলাসবহুল স্পোর্টস কার ভাঙচুর করছে, মন্ত্রীর বাড়ি থেকে দামি আসবাব নিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব হামলায় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীও যুক্ত থাকতে পারে। তবে জনগণের ক্ষোভের মূল লক্ষ্য স্পষ্ট। তা হলো দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক শ্রেণি।

প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো প্রথমে আন্দোলনকারীদের ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে আখ্যা দেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনরোষে তিনি ঘোষণা দেন, এমপিদের বাসভাতা কমানো হবে, বিদেশ সফর স্থগিত থাকবে। পাশাপাশি সেনা ও পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। তবু আন্দোলন থামেনি। জানা গেছে, গোলাপি এসেছে সাহসী প্রতিবাদী নারীদের কাছ থেকে। যেমন সংসদ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে গোলাপি হিজাব পরে জাতীয় পতাকা নাড়ানো সেই তরুণীর ছবি। সবুজ এসেছে ডেলিভারি কর্মী আফফানের রক্তাক্ত মৃত্যুর প্রতীক হয়ে। তাই আন্দোলনের নতুন সেøাগান ‘সাহসী গোলাপি, বীর সবুজ’।

ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রবৃদ্ধি দেখালেও সাধারণ মানুষের কাছে তার সুফল পৌঁছায়নি। বরং বৈষম্য বেড়েছে। সংসদ সদস্যদের বিলাসী জীবনযাত্রা আর জনগণের হতাশা এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রাবোও সরকারের সামনে এই ‘সিস্টেম রিসেট’ আন্দোলন কি শুধু সাময়িক অস্থিরতা, নাকি ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড অ্যাসপিনাল চলমান বিক্ষোভকে ১৯৯৮ সালের রেফর্মাসি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এই নতুন তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনে অংশগ্রহণ আর উন্মুত্ততার একটা গুণ আছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটায় দৃঢ় সংগঠন ও স্পষ্ট মতাদর্শের অভাবও রয়েছে, যা মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা।

মাতৃভূমির খবর

Link copied!