বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বর্তমান বাস্তবতায় একটি মৌলিক প্রশ্ন বারবার উঠে আসে: সংসদে কি জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামতের প্রতিফলন ঘটছে? বিদ্যমান first-past-the-post (FPTP) বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় এমন একচেটিয়া রাজনীতির জন্ম হয়েছে, যেখানে ভোটের হার আর সংসদের আসনসংখ্যার মাঝে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া যায় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি (Proportional Representation – PR) নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—বাংলাদেশের জন্য PR পদ্ধতি কতটা উপযোগী? এর সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবায়নের করণীয় কী?
কী এই PR পদ্ধতি?
PR এমন এক নির্বাচন ব্যবস্থা যেখানে রাজনৈতিক দলসমূহ সংসদে আসন পায় তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। এর দুটি মূল ধরন হলো:
পার্টি-লিস্ট PR: ভোটাররা একটি দলকে ভোট দেয় এবং সেই দলের প্রস্তুত করা তালিকা থেকে সদস্য নির্বাচিত হয়।
মিশ্র পদ্ধতি (MMP): কিছু আসনে FPTP ও বাকি আসনে PR ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে PR-এর প্রয়োজনীয়তা
জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন:
বর্তমানে একটি দল ৪০% ভোট পেয়েও ৭০% আসন পায়, অপরদিকে ৩০% ভোট পেয়ে অন্য দলটি একটিও আসন পায় না—এ এক চরম বৈষম্য। PR এই সমস্যার কার্যকর সমাধান হতে পারে।
ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের সুযোগ:
বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য বা ওয়ার্কার্স পার্টির মতো দলগুলোর সংসদে প্রতিনিধিত্ব প্রায় নেই। PR পদ্ধতিতে তাদেরও কণ্ঠস্বর মিলবে।
সংঘাতহীন নির্বাচন:
PR পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট আসনে জেতা-হারার ওপর নির্বাচন নির্ভর না করায় সহিংসতা কমে যেতে পারে।
সমঝোতার রাজনীতি:
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় জোট গঠনের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় থাকে।
চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
জটিলতা ও বিভ্রান্তি:
গ্রামীণ ও স্বল্প-শিক্ষিত ভোটারদের জন্য PR পদ্ধতি বোধগম্য নাও হতে পারে।
সরকার গঠনে জটিলতা:
বহুদলীয় অংশগ্রহণে সরকার গঠন দেরি হতে পারে, অচলাবস্থার আশঙ্কাও থাকে।
প্রার্থী নির্ভরতা কমে যাওয়া:
PR পদ্ধতিতে সরাসরি প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে দলকে ভোট দিতে হয়, ফলে স্থানীয় দায়বদ্ধতা কমে যেতে পারে।
দলীয় কর্তৃত্ব:
প্রার্থী তালিকা তৈরির ক্ষমতা দলীয় নেতৃত্বের হাতে থাকায় স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি বাড়তে পারে।
অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা
দেশ
|
পদ্ধতি
|
অভিজ্ঞতা
|
নেপাল
|
মিশ্র PR
|
জাতিগত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে
|
জার্মানি
|
MMP
|
জোট সরকার কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়
|
ভারত
|
FPTP
|
মেজরিটি নির্ভর হলেও বহুদলীয় অংশগ্রহণ সীমিত
|
দক্ষিণ আফ্রিকা
|
PR
|
সকল জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়
|
এই উদাহরণগুলো থেকে বোঝা যায়, যথাযথ প্রয়োগ ও প্রস্তুতি থাকলে PR একটি কার্যকর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা হতে পারে।
করণীয় ও সুপারিশ
জাতীয় আলোচনার সূচনা: নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে PR পদ্ধতি নিয়ে গবেষণামূলক প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে।
পরীক্ষামূলক প্রয়োগ: স্থানীয় সরকার পর্যায়ে যেমন ইউপি, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলোতে PR চালু করা যেতে পারে।
মিশ্র পদ্ধতির বিবেচনা: সরাসরি পুরো PR নয়, বরং FPTP ও PR-এর সংমিশ্রণ হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবধর্মী সমাধান।
ভোটার শিক্ষা: জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচারণা ও প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে।
দলীয় গণতন্ত্রের চর্চা: স্বচ্ছ প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ার জন্য দলীয় অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র জোরদার করা জরুরি।
প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। তবে এটি কোনো ম্যাজিক নয়। এর সফল বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, গণতান্ত্রিক চর্চা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির ওপর। আমাদের সময় এসেছে বিকল্প নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার—যাতে আগামী দিনের গণতন্ত্র হয় আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও প্রতিনিধিত্বমূলক।
লেখক পরিচিতি:
অনিরুদ্ধ অনিকেত, রাজনীতি বিশ্লেষক ও গবেষক।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor