বিএনপি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার: গণতন্ত্রের বিপন্নতা ও মতপ্রকাশের সংকটের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জনমত যখন ভুলের পক্ষে গড়ে ওঠে, তখন সেই জনমত সঠিক পথে আনার প্রচেষ্টাও একটি ভুল কাজ। তারপরও বিবেকের দায় থেকে অনেক দিন পর লিখতে বসলাম। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠন বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ডে বাংলাদেশের মিডিয়াকে খাদ্য যুগিয়েছে। তন্মধ্যে চাঁদবাজি নিঃসন্দেহে অন্যতম। তবে ঘটনা যাই ঘটুক অধিকাংশ মিডয়াই আধিপত্য বিস্তার, দলীয় অন্তর্কোন্দল এবং পাওনা টাকা ফেরত চাওয়াকেও বিএনপি ও তার অংগ-সংগঠনের চাঁদাবাজি হিসেবে চিত্রিত করেছে। সম্প্রতি পুরাণ ঢাকার তামার তার ব্যবসাকেন্দ্রিক যুবদল-ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে যেভাবে চাঁদাবিাজি হিসেবে তুলে ধরে, তাতে বিএনপি এই মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায় বিতাড়িত আওয়ামীলীগের মতোই ঘৃণিত ও সমালোচিত। যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে তা পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য ও চূড়ান্ত শাস্তির দাবি রাখে। তবে ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন না করেই বিএনপিকে একরফাভাবে দোষারোপ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘আমার ভাই মরলো কেন্? তারেক জিয়া জবাব দে’ স্লোগানের পেছনে কোন পরিকল্পিত ষঢ়যন্ত্র আছে কি না তা বিএনপি-জামায়াতকে খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ বিএনপি-জামায়াত- এনসিপি’র মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি তৃতীয় কোন দেশদ্রোহী গ্রুপ জড়িত কি না তা দেখা প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশকে নিয়ে অবিরাম গবেষণায় রত ‘র’ ও তার এদেশীয় কোন এজন্ট ফ্যাসিস্টবিরোধী দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর মাঝে মারাত্মক সংঘাত লাগাতে চায় কি না তা রাজনৈতিক বোদ্ধাদের পুনঃপুন ভাবতে হবে। তা না হলে এমনভাবে কেন হচ্ছে বিএনপি মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার? এরপর হবে জামায়াত। তারপর হবে এনসিপি। ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্টলীগ ষঢ়যন্ত্রের পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে।
গণমাধ্যমের বিচারিক ক্ষমতা থাকতে নেই: গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম। যেখানে গণমাধ্যম অবাধ ও পক্ষপাতহীন, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা টিকে থাকে, সত্য উদঘাটিত হয়, রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ আজ দলীয় নিয়ন্ত্রণ ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর একটি বড় শিকার হলো অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বর্তমান সরকারের সময় বিএনপি যেন একটি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’-এর চক্রে আটকে গেছে। নানা ইস্যুতে দলটির বিরুদ্ধে বিচারপূর্ব অপবাদ, রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহনন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে সমাজে একটি বিভ্রান্তিকর চিত্র গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে করে শুধু বিএনপি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গণতন্ত্র ও মতবাদের বহুত্ববাদ।
মিডিয়া ট্রায়াল দেশ ধ্বংস করে: মিডিয়া ট্রায়াল বলতে বোঝায়, কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে এমনভাবে খবর প্রচার করা, যাতে সাধারণ মানুষ আগে থেকেই তাদের দোষী ধরে নেয়। এমনকি আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে রায় ঘোষণার আগেই। এমন হওয়ার কারণ পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ কাভারেজ, মনগড়া সংবেদনশীল হেডলাইন। বিভ্রান্তিকর চিত্র, তথ্য ও উপস্থাপনা। রাজনৈতিক প্রভাবিত টকশো ও বিশেষ অনুষ্ঠান। এই প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার, যুক্তি ও তথ্য গৌণ হয়ে পড়ে; মূলত চরিত্রহনন ও জনমত প্রভাবিত করাই হয় মূল উদ্দেশ্য। এতে করে দেশে গভীর ও সুদূর প্রসারী সংকট তৈরি হয়। বিএনপিকে ‘অপরাধী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা: তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা মামলার রায়ের আগে থেকেই তাকে ‘অপরাধী’, ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে প্রচার করা হয়। অথচ কোনো মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু টেলিভিশন টকশো, রিপোর্ট ও বিশেষ পর্বে বারবার এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সাথে সাথে দলটির বিরুদ্ধেও নানাবিধ সহিংসতার একতরফা দোষারোপ একটি সামাজিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। যেকোনো আন্দোলনে সংঘর্ষ বা অস্থিরতা দেখা দিলেই মিডিয়ায় বার্তা আসে: ‘বিএনপির সন্ত্রাস’, ‘জ্বালাও-পোড়াও বিএনপির নীতি’, ইত্যাদি। এমনকি দলটির নেতারা যখন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ডাক দেন, তখনও একপাক্ষিকভাবে তাদেরকে ‘গুজব রটনাকারী’, ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ও ‘দেশবিরোধী’ হিসেবে প্রচার করা হয়। বিরোধী নেতাদের ‘বিদেশি চক্রান্তের এজেন্ট’ হিসেবে আখ্যা। এবং মিডিয়ার কিছু অংশ ও পত্রপত্রিকায় বিএনপির নেতাদেরকে কখনও ‘ভারতবিরোধী’, কখনও ‘পাকিস্তানপন্থী’, আবার কখনও ‘ইসরাইলি এজেন্ট’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এগুলোর পেছনে কোনো প্রমাণ নেই, বরং শুধুই মতবিরোধের প্রতিশোধমূলক প্রচার।
এই ধরনের মিডিয়া ট্রায়ালের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: বিএনপিকে ‘দেখিয়ে শাস্তি’ দেওয়া। যেহেতু দেশের আইনি ও বিচারব্যবস্থাও ক্ষমতার প্রভাবাধীন, সেখানে প্রতিপক্ষকে মিডিয়া মারফত আগেভাগেই অপরাধী বানানো হলে, বিচারকেও প্রভাবিত করা সহজ হয়। জনমত বিভ্রান্ত করে দলকে বিচ্ছিন্ন করা এসব প্রচার ও অপপ্রচারের মূল লক্ষ্য। সাধারণ মানুষ রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের ওপর প্রভাব পড়ে। যখন প্রতিনিয়ত নেতিবাচক বার্তা, অর্ধসত্য খবর ও পক্ষপাতদুষ্ট বিশ্লেষণ প্রচার করা হয়, তখন জনগণের একটি বড় অংশ স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি’র প্রতি ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হয়। এসবের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ‘একটি পরিশুদ্ধ আওয়ামীলীগ’ মাঠে নামানোর ইস্যু থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে রাখা। দেশে যখন গণতন্ত্রের সংকট, নিরপেক্ষ নির্বাচনের রোডম্যাপ দুর্নীতি, অর্থ পাচার, নানবিধ অনিয়ম নিয়ে কথা ওঠে-তখনই বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো পুরনো ইস্যু উস্কে দিয়ে ‘ডাইভারশনাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন’ চালানো হয়।
মিডিয়া ট্রায়ালের ফলাফল: গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের ক্ষতি জনগণের মধ্যে অবিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সার্বিক উন্নয়ন ও সুশাসন সম্ভব নয়। মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা দেখে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। বিএনপির নেতারা মনে করেন। তাদের কিছু বলার দরকার নেই, মিডিয়া আগে থেকেই ‘রায়’ দিয়ে দিচ্ছে। এতে করে আদালতের উপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যখন গণমাধ্যমে আগেভাগেই কাউকে দোষী প্রমাণ করে ফেলা হয়, তখন বিচারক বা আইনজীবীদেরও মানসিকভাবে স্বাধীন থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তখন মতপ্রকাশের সংকোচন ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণই একমাত্র টিকে থাকার অবলম্বন মনে হয়। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক বা সাধারণ সমর্থকরাও মিডিয়ার এই মনোভাব দেখে নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশে সংযত হয়ে যান। এতে করে মতপার্থক্যের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়ে।
সমাধান কোন পথে: এসব থেকে উত্তোরণের পথ বিএনপিকেই খুঁজতে হবে। দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা মারাত্মক রকম। জ্যেষ্ট নেতাদের সামনেই কনিষ্ঠ নেতারা হাত-পা নেড়ে যেভাবে বিক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন, যেভাবে অবজ্ঞা করেন, তাতে তৃণমূল পর্যায়ে এর কুপ্রভাব পড়ে। বিএনপি’র ‘চেন অব কমান্ড’ ঠিক করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় ভারতের ব্যাপারে বিএনপি’কে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। বাংলাদেশের যুবক-তরুণ প্রজন্ম ভারতের দাদাগিরিকে আর পাত্তা দিতে চায় না। বিএনপি যদি তা না বোঝে তাহলে আ.লীগের চেয়েও বড় খেসারত দিতে হতে পারে। জামায়াতকেও মনে রাখতে হবে- আ.লীগের ভারত আশ্রয় দেয়; কিন্তু জামায়াতকে দেবে না। বিএনপিকেও দেবে না। সুতরাং নিদানকালে জামায়াত-বিএনপি ও এনসিপিকে বাংলাদেশেই থাকতে হবে। অথবা বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিতে হবে। তাই এই ৩ দলকে মিডিয়া ট্রায়ালের ব্যাপারে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে যুথবদ্ধভাবে।
লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক