ইউনূসের পদত্যাগ গুঞ্জন: রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়ার ঝড়
আপলোড সময় :
২৩-০৫-২০২৫ ০৮:৫৪:৫৩ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২৩-০৫-২০২৫ ০৮:৫৪:৫৩ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সম্ভাব্য পদত্যাগের খবর।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গণমাধ্যমকে এই আশঙ্কার কথা জানান।
এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে, যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া একাধিক পোস্ট বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ও অবস্থান
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের খবর এমন এক সময়ে প্রকাশ্যে এলো যখন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বৃহস্পতিবার দিনভর উত্তেজনার পর বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের 'বিতর্কিত উপদেষ্টাদের' সরানোর দাবি জানিয়েছে।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা তুলেছিলাম।"
তিনি আরও যোগ করেন, "জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার গতকালকের বক্তব্য আবারও নতুন বির্তকের জন্ম দিয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে।"
দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য জামায়াতে ইসলামী প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে। দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরি বৈঠকের পর এই আহ্বান জানানো হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জামায়াতের এই আহ্বান চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় একটি নতুন আলোচনার দিক উন্মোচন করেছে, যেখানে তারা সংকটের সমাধানে সকল দলের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ পাঁচটি দলের এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের দ্বারা গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, "জুলাইয়ের ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল শক্তির প্রতি আহ্বান— যে বিভাজনটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছিলো, সেই বিভাজনকে দেশ ও জাতির স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে।"
তার মতে, "আমরা সবাই এক হয়েছিলাম বলে দীর্ঘ দেড় যুগের শক্তিশালী ফ্যাসিবাদকে তছনছ করতে পেরেছিলাম। আমরা খণ্ড বিখণ্ড হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসরেরা আমাদের তছনছ করার হীন পায়তারা করবে।"
হাসনাত আব্দুল্লাহর এই বক্তব্য মূলত জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত ঐক্য ধরে রাখার এবং দেশ গঠনে মনোনিবেশ করার একটি আকুতি। তিনি মনে করেন, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ নয়, দেশের স্বার্থেই এই ঐক্য অপরিহার্য।
এ সংকটময় পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, যাদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে, তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ফেসবুক পোস্টে এক সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, "BAL, North & Delhi জোটভুক্ত হয়ে যে কুমির ডেকে আনছেন তা আপনাদেরকেই খাবে।"
এখানে 'BAL' বলতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, 'North' বলতে দেশের সামরিক বা শক্তিশালী কোনো গোষ্ঠীকে এবং 'Delhi' বলতে প্রতিবেশী ভারতের প্রভাবকে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করছেন।
তার এই বক্তব্য একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি হুঁশিয়ারি, যারা হয়তো পুরোনো শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে নতুন কোনো মেরুকরণের চেষ্টা করছে। তিনি আরও হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, "স্বপ্ন দেখে স্বপ্নভঙ্গের কষ্টই বোধহয় এদেশের ভাগ্য।"
দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ নিয়ে গভীর শঙ্কা ফুটে উঠেছে তার এই পোস্টে।
তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে অতীতের "বিভাজনমূলক বক্তব্য ও শব্দচয়নের কারণে" আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
তিনি লিখেছেন, "ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড় দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য।" তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করছেন এবং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চান।
মাহফুজ আরও উল্লেখ করেন, "পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী শ্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যত রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।"
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী, তাই দেশবাসীর সামনে ঐক্য ও ধৈর্যের দীর্ঘ পরীক্ষা রয়েছে, যা সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।
উল্লেখ্য, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরবর্তীতে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের দাবিতে গড়ায়।
সার্বিক পরিস্থিতি
অধ্যাপক ইউনূসের সম্ভাব্য পদত্যাগের গুঞ্জন, বিএনপির কঠোর অবস্থান, বিভিন্ন দলের ঐক্য ও সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান এবং খোদ উপদেষ্টাদের কারো কারো হতাশা ও ঐক্যের ডাক – সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
একদিকে যেমন জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত পরিবর্তন ধরে রাখার প্রয়াস, অন্যদিকে, পুরোনো শক্তির পুনরাবির্ভাবের আশঙ্কা এবং নতুন বিভাজনের খেলা – এই সবকিছুর মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরবর্তী পদক্ষেপের ওপরই নির্ভর করছে এই ডামাডোলের অবসান কোন পথে ঘটবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স