নেতার আশীর্বাদে এক লাফে উপসচিব
আপলোড সময় :
২৭-০৪-২০২৫ ১০:১৫:৫২ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় :
২৭-০৪-২০২৫ ১০:১৫:৫২ পূর্বাহ্ন
সংসদ সচিবালয়ের একজন দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পদোন্নতি হওয়ার আগেই অবৈধভাবে সরাসরি উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী পদমর্যাদা) আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সুপারিশে ২০২১ সালে এই পদোন্নতি দেয় তার কার্যালয়। আর যাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তিনি হলেন কমিটির আহ্বায়কের নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া একান্ত সচিব এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মোহাম্মদ খায়রুল বশার।
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় জালিয়াতির মাধ্যমে এই অবৈধ পদোন্নতি নিয়ে সংসদ সচিবালয় কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেউই তখন কোনো কথা বলার সাহস দেখাননি। যদিও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংসদ সচিবালয় এই পদোন্নতি মেনে নেয়নি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংসদ সচিবালয়ে পদোন্নতির ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। জুনিয়রদের পদোন্নতি দেওয়া হলেও ১৫ বছর ধরে পদোন্নতি না পেয়ে একই পদে চাকরি করে অবসরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ থাকাকালে খায়রুল বশার তার প্রিভিলেইজ পিএ (ব্যক্তিগত সহকারী) হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি অফিস সহকারী হিসেবে সংসদ সচিবালয়ে চাকরি পান এবং ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। ওই বছরই এলজিআরডি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর একান্ত সচিব (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে মন্ত্রী পদমর্যাদায় পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক বানানো হলে খায়রুল বশার পিএস হিসেবে যোগ দেন। এ সময় সংসদ সচিবালয় তাকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা থেকে কমিটি অফিসারের চলতি দায়িত্ব দেয়। দ্বিতীয় শ্রেণির কোনো কর্মকর্তাকে মন্ত্রী বা মন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তির পিএস নিয়োগেরও কোনো সুযোগ নেই বলে জানান সংসদ সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। কারণ মন্ত্রীদের পিএস করা হয় উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে। এর পর ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়কের কার্যালয় পিএস খায়রুল বশারকে পঞ্চম গ্রেডের বেতন স্কেলে উপসচিব (নন ক্যাডার) হিসেবে পদোন্নতির আদেশ জারি করে। আবুল হাসানাতের এপিএস মিন্টু বিকাশ চাকমার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বলা হয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পদোন্নতি আদেশ জারি করা হয়েছে। আদেশের কপি সংসদ সচিবালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসারসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়। ওইদিনই খায়রুল বশার উপসচিব হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়কের কাছে যোগদান করেন।
সংসদ সচিবালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সাল থেকেই তিনি উপসচিব হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বেতন-ভাতা নিয়েছেন। তারা জানান, সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এসব পদে পদোন্নতি ও পিএসসির পদোন্নতির সুপারিশ ছাড়া একজন নন গেজেটেড কর্মকর্তাকে কীভাবে উপসচিব পদোন্নতি দেওয়া হলো এবং প্রিভিলেইজ এপিএস কীভাবে এই পদোন্নতি আদেশ জারি করল তা নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মীয় হওয়ায় এতদিন এ নিয়ে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পাননি।
তবে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর বিষয়টি সামনে আসে। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মানবসম্পদ শাখা গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে কমিটি অফিসারের চলতি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে দশম গ্রেডের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে পুনর্বহাল করে। এই অফিস আদেশের বিরুদ্ধে খায়রুল বশার হাইকোর্টে গেলে কোর্ট তাকে কমিটি অফিসারের চলতি দায়িত্ব পদে বহাল রাখার আদেশ দেন। গত ৯ মার্চ জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিবের কাছে কমিটি অফিসার (চলতি দায়িত্ব) পদে যোগদানপত্রে তিনি লিখেছেন সংসদ সচিবালয়ে এই পদে নিয়োজিত থাকাকালীন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়কের একান্ত সচিব পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে ২০১৯ সালের ১ মার্চ যোগদান করেন। গত ১২ জানুয়ারি সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি পুনর্গঠন করে এবং আহ্বায়কের একজন নতুন একান্ত সচিব যোগদান করেন। এ অবস্থায় একান্ত সচিব হিসেবে তার থাকা সম্ভব নয় বিধায় তিনি ১৫ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগদান করে পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ গ্রেডের যেকোনো একটি পদে পদায়নের আবেদন করেন। কিন্তু তার আবেদনের বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত নয় বিধায় তার পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগদানপত্র গ্রহণ করার সুযোগ নেই বলে গত ৬ মার্চ মন্ত্রণালয়ের সচিব তাকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়ে তাকে তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে যোগদান করার পরামর্শ দেন। এ কারণে তিনি সংসদ সচিবালয়ে যোগদান করছেন।
এ বিষয়ে খায়রুল বশার সময়ের আলোকে জানান, তিনি আর এখন উপসচিব নন। সংসদ সচিবালয়ের কমিটি অফিসার (চলতি দায়িত্ব) তিনি।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, খায়রুল বশার দীর্ঘদিন অবৈধভাবে উপসচিব হিসেবে বেতন-ভাতা নিয়েছেন। তার প্রমাণ তিনি সংসদ সচিবের কাছে গত মাসে যে যোগদানপত্র দিয়েছেন তাতে নিজেই দাবি করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে তিনি গ্রেড-৫ হিসেবে যোগদানের আবেদন করেছিলেন। কারণ তিনি সংসদের দশম গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও সরাসরি পঞ্চম গ্রেডের বেতন-ভাতা নিয়েছেন এবং সংসদের উচ্চমান আবাসিক এলাকায় যুগ্ম সচিবদের এনএ সি-৫ বাংলো বরাদ্দ নিয়ে এখনও বসবাস করছেন। ৫ আগস্টের পর সংসদের নতুন সচিব তার বাসা বাতিল করার পর তিনি আদালতের মাধ্যমে বাসা বরাদ্দ বহাল রেখেছেন।
অন্যদিকে ১৯৯১ সাল থেকে পিএসসির সুপারিশে সংসদ সচিবালয়ে নিয়োগ পাওয়া অনেক নিয়মিত কর্মকর্তাকে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। ২০০৬ সালের উপসচিব পদমর্যাদার পরিচালক কামরুল ইসলামকে (বিতর্ক সম্পাদনা ও প্রকাশনা) শুধু বিএনপি আমলে নিয়োগ এই বিবেচনায় গত ১৭ বছর কোনো পদোন্নতি না দিয়ে ২০২৪ সালে অবসরে পাঠানো হয়। তার অপরাধ তিনি বিএনপি আমলে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলীর এপিএস ছিলেন।
এ ছাড়া সংসদে আইন ও বিল পরীক্ষার অভিজ্ঞ সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান ফজলুর রহমানকে ২০০৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত তকমা দিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি অনেক সিনিয়র ও অভিজ্ঞ এ বিবেচনায় পদোন্নতি কমিটি পদোন্নতির সুপারিশ করলেও ২৩ মাস স্পিকার নথি আটকে রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত তাকে পরিচালক বা উপসচিব পদোন্নতি না দিয়ে কোনো দিন ড্রাফটসম্যান হিসেবে কাজ না করলেও পরিচালক/উপসচিব পদে দলীয় বিবেচনায় সাবেক রেলমন্ত্রীর এপিএস জসিম উদ্দিনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সিনিয়র সহকারী সচিব নাজমুন নাহারকে দীর্ঘদিন কোনো পদায়ন না করে ফেলে রাখা হয়েছিল। আবার উপসচিব পদোন্নতির সময় সিনিয়রিটি না মেনে তার জুনিয়র কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তবে ৫ আগস্টের পর নাজমুন নাহার উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন।
এ ছাড়া পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগকৃতদের সিনিয়রিটি না মেনে তালিকায় নিচে থাকা অনুগত একাধিক কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তৎকালীন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর এপিএসকে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল অনেককে বঞ্চিত করে।
অন্যদিকে মুকুল হোসেন নামে সংসদ সচিবালয়ের সাবেক কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে তৎকালীন একজন প্রতিমন্ত্রীর পিএসের দায়িত্ব পালন শেষে সংসদে যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ থাকায় তিনি ছুটি নিয়ে আমেরিকা চলে যান। ছুটি শেষে ফিরে এসে যোগ না দেওয়ায় সংসদ সচিবালয় পত্রিকায় নোটিস দিয়ে তাকে যোগদান না করলে চাকরি থেকে কর্মস্থলে অননুমোদিত অনুপস্থিতির কারণে অব্যাহতি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এখন ১৬ বছর পর তিনি দেশে ফিরে এসে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে হারানো চাকরি ও বকেয়া বেতনের জন্য তদবির করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব (অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সাপোর্ট উইং) জাকিয়া আফরোজ জানান, বিষয়টি তার দফতর দেখে না। তাই তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে সংসদ সচিবালয়ের একজন যুগ্ম সচিব জানান, ৫ আগস্টের পর দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তাদের পদোন্নতির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। তবে বিগত আওয়ামী লীগের আমলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম হয়েছে সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
সুত্র: সময়ের আলো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin
কমেন্ট বক্স